পর্ব তিন: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

 

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আমি এখনও মুসলিম মিল্লাতের একজন স্বজন বলে মনে করি। তিনি যদিও ১৯৭৫ সালের পর থেকে অব্যাহতভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুশমনের ভূমিকা পালন করে আসছেন। এই তিক্ত মন্তব্য করলাম অকারণে নয় বরং কারণে। 'কারণ'-এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে এ আলোচনায় ৷

মুসলমান হয়ে ইসলাম আর মুসলিম মিল্লাতকে খোঁচা দেয়া, আঘাত করা, দু'চারটা গালি দেয়া, মুসলমানের দোষ-ত্রুটি চিহ্নিত করে কলমবাজি করা হলো বামপন্থী, তথাকথিত প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার এলার্জিগ্রস্তদের বাতিক বিশেষ। আজকাল এ মানসিকতা অনেকেই লালন করছেন। জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও এই মানসিকতার মানুষ সেজেছেন।

তিনি ইসলাম আর মুসলমানের সমালোচনা করে থাকেন নিয়মিত। যতই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, ততই তাঁর মধ্যে মুসলমানকে গালি দেয়ার তেজ বাড়ছে। এতদসত্ত্বেও আমি বলবো, তিনি নাস্তিক নন, মুরতাদ নন, যদিও তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জঘন্যতম দিগম্বরী পতিতা তসলিমা নাসরিনের জীবন-দর্শনের একজন কট্টর সমর্থক। হ্যাঁ, তিনি যে সুবিধাবাদী একজন সেকুলারিস্ট, তা কিন্তু আমি না বলে পারছি না। তাঁর বৈষয়িক চিন্তা একান্তভাবে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক। সামান্য কারণে তার জীবন-কম্পাসের কাঁটা বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। যেখানে স্বার্থ নেই, সেখানে তিনি নেই। স্বার্থ আছে যেখানে, জনাব চৌধুরী আছেন সেখানে। এ জন্য তিনি স্বার্থের হাওয়া বুঝে দিক পরিবর্তন করেন। তবে এ কথা সত্য যে, ১৯৭৫ সালের আগে আমি তাঁকে মুসলিম বিরোধী ভূমিকা পালনে দেখিনি । তাই বলে তিনি যে মুসলমানদের একজন প্রিয় স্বজন ছিলেন, এ কথাও আমি বলছি না ।

বরিশাল জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ (১৯৩৪) করেন। মুসলিম ঐতিহ্য-পরিবেশে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে । সে কারণে তিনি ধর্মীয় শিক্ষাও কিছুটা লাভ করেন । তাঁর আকিকা, খতনা ও বিবাহ ইসলামী বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেখেছি, জনাব চৌধুরীর লেখনী মুসলমানদের পক্ষে শাণিত তলোয়ার হিসাবে স্বজনের ভূমিকা পালনে ব্যবহৃত হতে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাঁর হাতে যে কলম দেখেছি, সে কলম ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে এক চাবুকের মত। সে সময়ের তাঁর সাহসী কলমের আবাদ করা অনেক ফসল আজও আমি সযত্নে ধরে রেখেছি। আওয়ামী লীগের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হয়েও তিনি তাঁর প্রিয় দলের নীতি ও কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছেন । কোন কোন বিষয়ের বা ইস্যুর ওপর তিনি সাহসী প্রতিবাদী লেখা লিখেছেন, যা সে সময়ে ও সে পরিবেশে এমন কঠোর ভাষায় সমালোচনা করার মত সাহসী লোক সারা দেশে মাত্র ৫/৭ জনের বেশি ছিলেন না। সত্য প্রকাশে সাহসী এই ব্যক্তিটি ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের পর হয়ে গেলেন অন্য মানুষ। দেশ ছেড়ে তিনি বিদেশে পাড়ি জমালেন। বিলেতে আশ্রয় নিলেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব আহমদ মুসার মন্তব্য ছিল এই, (দৈনিক দিনকাল ১৯/১/৯৩) তিনি (আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী) শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বিলেতে কাতর স্বরে বলতেন আর সিলেটিদের মন গলাতেন। দেশে ফিরে গেলে তাঁর বিপদ হতে পারে, এ কারণ দেখিয়ে লন্ডনে 'পলিটিক্যাল এসাইলাম' চাইলেন, পেয়েও গেলেন। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে দেশ থেকে তাঁর দুই মেয়ে ও এক পুত্রকেও নিয়ে গেলেন। তারপর একদিন লন্ডনে ইন্ডিয়ান দূতাবাস থেকে গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে এক সুখবর এলো। গাফ্ফার চৌধুরী গেলেন ইন্ডিয়ান দূতাবাসে। প্রথম কিস্তিতে পেলেন নগদ পাঁচ হাজার পাউন্ড আর দিল্লি থেকে পাঠানো শেখ হাসিনার ছোট্ট একটি চিঠি।

১৯৭৫ সালে দেশ ছাড়ার ১৮ বছর পর ১৯৯৩ সালের ৫ই জানুয়ারি তিনি স্ত্রী এবং এক কন্যাসহ বাংলাদেশে আসেন। দেশে কিছু দিন ছিলেন। তিনি তাঁর চিন্তাধারার কাছাকাছি বিভিন্ন পত্রিকায় অনেক লেখা ছাপিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, ঢাকায় তিনি লাল গালিচা সংবর্ধনা পাবেন, কিন্তু পাননি। হতাশ হয়েছেন, ক্ষোভও নাকি প্রকাশ করেছেন। যখন বুঝতে পারলেন যে, অনাদরের মাত্রা বাড়ছে, তখন সময়ের আগেই বিলেতে ফিরে গেলেন ।

১৯৭৫ সালের পর থেকে তিনি বিলেতবাসী হয়েও কলম বন্ধ করেননি ঘাদানিপন্থী কাগজগুলোতে নিয়মিত লিখতেন এবং এখনও লিখেন। ১৯৭৫-এর পর থেকে তিনি যে সব বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি লেখালেখি করেন, তাহলো ইসলাম, মুসলমান, ইসলামের ইতিহাস, মুসলিম রাজনীতি, পাকিস্তান, মুসলিম দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, তসলিমা, বামপন্থী রাজনীতি, ইসলামপন্থী দলসমূহ, ঘাদানি প্রশস্তি ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম আর মুসলমানদের ওপর আঘাত করেই লেখালেখি করে থাকেন। আমি এসব মন্তব্য করিনি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। প্রমাণ আছে আমার ফাইলে । ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত তিনি ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে যত লিখেছেন, সে সব লেখার জবাব দিতে হলে কয়েকখানা পুস্তক রচনার প্রয়োজন । সে পদক্ষেপ নেব না এবং এমন ইচ্ছাও রাখি না। এখানে আমি তাঁর একটি মাত্র লেখার ওপর আলোচনা করছি। যে লেখাটি ১৯৯২ সালের ১০ই এপ্রিল ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকে ছাপা হয় ।

দৈনিকটিতে প্রকাশিত (১০ই এপ্রিল ১৯৯২) তাঁর তৃতীয় মত' শিরোনামের লেখায় প্রথমে তিনি ইসলামের প্রতি যথেষ্ট দরদ দেখিয়েছেন। তারপর ধীরে ধীরে পঞ্চম বাহিনীর পাকা লোকের মত ইসলামের সীমানায় প্রবেশ করে মুখোশ খুলে খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া আমল, আব্বাসীয়া আমল, কারবালা, শিয়া-সুন্নী ঝগড়া, মুসলমান-কাদিয়ানী দাঙ্গা, ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের রাজনীতি, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সাদ্দাম হোসেন, মোয়াম্মার গাদ্দাফী, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, সৌদী আরব, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং তথাকথিত গণআদালত প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করে যেমন খুশি তেমন গালিগালাজ করেছেন । তাঁর বে-নেকাব গালাগালির মূল টার্গেট যে ইসলাম, তা বেশ বুঝা যায়। তিনি পাঠককে বুঝাতে চেয়েছেন, এই বিশ্বে যত মারামারি, কাটাকাটি, খুনাখুনি, ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর রক্তারক্তি হয়, সবই হয় মুসলমানদের মধ্যে। তিনি বলেছেন, তিনজন খলিফাকে হত্যা করেছে মুসলমানরা। আব্বাসীয় ও উমাইয়া বংশের ইতিহাস হচ্ছে নৃশংসতার ইতিহাস। ইসলাম যেখানে আছে, সেখানেই খুন আর বিরোধ। সৌদি আরব বিশ্বের সব জায়গায় গোলমাল লাগায়। রোহিঙ্গা সংকটও সৌদি আরব সৃষ্টি করেছে। লন্ডনের কোন এক ইহুদি কাগজে নাকি তাই লিখেছে, তিনি তা বিশ্বাস করেছেন।

তৃতীয় মত’-এর লেখক, এ কথার মানে তিনি এ পক্ষেও নেই ঐ পক্ষে ও নেই, আছেন গ্যালারিতে, নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে। বাংলাদেশের মাঠে রাজনীতির যে খেলা হচ্ছে তা তিনি বিলেতের গ্যালারিতে বসে ইহুদি-খ্রিস্টানদের দূরবীন চোখে লাগিয়ে নিজের মানসিকতা তাতে যোগ করে দেখছেন, আর মাঝে মাঝে কমেন্টেটর হয়ে কমেন্ট করছেন। অভাব পূরণের গায়েবী চ্যানেল থাকলে কত রকমের ঢেকুর দেয়া যায়, তবে হজমের প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো বদহজমও হয় ৷

মুসলিম ইতিহাসের কোন পুরানো অধ্যায় বা বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের চলমান কোন ঘটনার গঠনমূলক দরদী আলোচনা একমাত্র তিনিই করতে পারেন, যিনি ইসলামী আমল ও ঈমান নিয়ে চলেন। অর্থাৎ এমন যার চরিত্র, তিনি স্বজাতিকে ভালোবেসে সমালোচনা করেন। এ সমালোচনায় থাকে দরদ। যার মধ্যে ইসলামের সেই চরিত্র নেই, তাঁর সমালোচনা হয় পক্ষপাতদুষ্ট। এক কথায় বলা যায়, তা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ। কিন্তু যাদের ঈমান আর চরিত্র ইসলামী চেতনা বিরোধী, সেক্যুলারিস্ট হয়ে জীবন-যাপন করাকে যিনি মনে করেন গর্ব, বছরে একবার ঈদের নামাজ আদায় অথবা বড়জোর সপ্তাহে একবার জুমার নামাজে মাত্র দু'রাকাতের জন্য হাজিরা দিয়ে মনে করেন ইসলামকে ধন্য করলেন, এমন যিনি বা যারা, তিনি বা তারা সময়-সুযোগ পেলেই ইসলাম আর মুসলমানদের গালি দেন আর নিজেদের মহান মুসলমান' বলে জাহির করার চেষ্টা করেন। তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় ত্যাগও করতে পারেন না নানা সামাজিক ও বৈষয়িক কারণে। নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়ে দিন যাপনও করেন না ধর্মান্ধ, মৌলবাদী বা অপ্রগতিবাদী হওয়ার ভয়ে । প্রবাসী এই চৌধুরী সাহেব সে সেই গোত্রের মুসলমান বলে আমি মনে করি । ঢাকায় থাকাকালীন তাঁকে সুবিধাবাদী মুসলমান হিসাবে দেখেছি। ঘন ঘন দিক পরিবর্তনে পারঙ্গম এই ওস্তাদ ব্যক্তিটিকে এখন একটি ক্ষেত্রে দেখেছি স্থির আর সেই ক্ষেত্রটি হচ্ছে, ‘ইসলাম আর মুসলমানদের গালাগালি করার ক্ষেত্রে'

প্রবাসী লেখক নিরাপদ দূরের গ্যালারিতে বসে লিখেছেন, 'ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আত্মঘাতী বিরোধ, রক্তপাত এবং অনৈক্য ছাড়া মুসলমানদের ইতিহাসে শান্তি ও ঐক্যের নজির পাওয়া যায়নি। প্রথম যুগের চার খলিফার মধ্যে তিনজনই নিহত হন মুসলমান ঘাতকের হাতে।'

ধন্যবাদ জানাই লেখককে । তিনি ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করার তো তকলিফ করেছেন। আমি অবশ্য এ প্রশ্ন তাঁকে করছি না যে, চৌধুরী সাহেব, যে সব ইতিহাস আপনি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, সে সব ইতিহাসের লেখক কারা ছিলেন? নিশ্চয়ই মুসলিম বিদ্বেষী খ্রিস্টান লেখকরা হবেন। আফসোস! ইসলামের এই দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে তিনি শুধু আত্মঘাতী বিরোধ আর রক্তপাত ছাড়া আর কিছুই পাননি। ইসলামের ইতিহাসে মহানুভবতা, বিশ্ব মানবিকতা, বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদান, সাম্য-মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা, নারীর মর্যাদা দান, দাস প্রথার

বিলুপ্তিসহ অসংখ্য অবদান ও উজ্জ্বল ঘটনার তিনি সন্ধান পাননি। তিনি যে অভিজাত হয়েছেন চৌধুরী' পদবী গ্রহণ করে (যদিও এ পদবী বংশ পরম্পরায় গ্রহণ করার কোন ভিত্তি ও যৌক্তিকতা নেই) তাও যে মুসলমান শাসকদের বদৌলতে পেয়ে জাতে উঠেছেন, এটাও কি ভুলে গেলেন? তিনি ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন ইসলামকে ঘায়েল করার মত কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই মানসিকতা ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে। যে নিয়তে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, তাই তিনি পেয়েছেন । নিরপেক্ষ নিয়ত নিয়ে অথবা ইসলাম আর মুসলমান প্রীতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে মন্দের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালো জিনিস তিনি আহরণ করতে পারতেন। কিন্তু সেই নিয়ত তাঁর ছিল না। তাই নিয়ত মুতাবেক তাঁর মওজুদ গড়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে তালাশ করলে পাওয়া যায় বিবেক, জ্ঞান, শিক্ষা ও উদারতা। কিন্তু এসব যদি তালাশ না করে কেউ মানুষের মধ্যে শুধু রোগ-জীবাণু তালাশ করে, তাহলে তাও পাওয়া যাবে। সুতরাং লক্ষ্য আর নিয়তের হেরফেরের কারণে আহরণেও হেরফের হয় ।

'প্রথম যুগের চার খলিফার মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করা হয়েছে’-এ কথা দ্বারা লেখক ইসলাম আর মুসলমানদের কোন্ দোষটা প্রমাণ করতে চান? তিনি দাবি করেছেন, ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। তিনি কি ঘাঁটাঘাঁটি করলেন তা বুঝলাম না। শুধু ইসলামের পেশাব-পায়খানাই ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন বলে মনে হয়। ইসলামের সঠিক ইতিহাস উদার মনে ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখতে পেতেন যে, এই তিন খলিফার কোন একজনও মুসলমানের হাতে নিহত হননি। হযরত ওমর (রাঃ)-এর হত্যাকারী ছিল আবু লুলু ফিরোজ নামের এক অগ্নি উপাসক ক্রীতদাস। যার বাড়ি ছিল ইরানে। হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারী ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার অনুসারী, ছদ্মবেশী ইহুদি। হযরত আলী (রাঃ)-এর হত্যাকারী ছিল ইবনে মুলআন নামের এক মুরতাদ। ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে নিবন্ধকার এই ঘাতকদের নাম আর পরিচিতিও কি জানতে পারেননি? মুসলমানদের 'আত্মঘাতী বিরোধ আর রক্তপাত'-এর প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনার মূলে মুরতাদরা যে সক্রিয় থাকে, তা কি লেখককে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে? ব্যাখ্যায় গেলে লেখক লজ্জা পাবেন এবং নিজের মুখোশও খসে পড়তে পারে।

জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, আহমদ শরীফ, দাউদ হায়দার, তসলিমা, সুফিয়া কামাল এবং জাহানারা ইমাম যে ভূমিকা পালন করেছেন, ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে অনুরূপ চরিত্রের নরনারী একই ভূমিকা পালন করে ইসলামের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে, গোলমাল বাঁধিয়েছে, রক্তপাত ঘটিয়েছে।

চার খলিফার তিন খলিফা অমুসলিমদের হাতে নিহত হওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী লেখক ইসলামের ইতিহাসকে আত্মঘাতী বিরোধ ও রক্তপাতের ইতিহাস বলার আস্পর্ধা দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মুসলমানরা খুন-খারাবীকেই ভালোবাসে, শান্তি-শৃঙ্খলা চায় না। তর্কের খাতিরে না হয় তাই মেনে নিলাম কিছুক্ষণের জন্য। তারপর লেখককে জিজ্ঞাসা করি, তিনি এমন একটা ধর্মের নাম বলুন, যে ধর্মের অনুসারীরা কখনো খুন-খারাবি করেনি, শান্তিতে দিন যাপন করেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান, কার কথা বলবেন? এসব জাতির ইতিহাস কি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন? বোধহয় করেননি। করে থাকলেও জ্ঞাত কারণে মুখ খুলবেন না। স্বজন যখন দুশমন হয়' এই শিরোনামের প্রথম প্রবন্ধটি পাঠ করুন। অতঃপর কথা বলুন । সভ্য দেশ বলে কথিত আমেরিকার ইতিহাসটা কি তিনি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন? যদি করে থাকেন, তাহলে জর্জ ওয়াশিংটন থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পর্যন্ত দীর্ঘ শাসনকালের মধ্যে তিনি রক্তের কোন দাগ কি প্রত্যক্ষ করেননি? ১৭৮৯ সাল থেকে যে দেশের সভ্যতা শুরু, (আমেরিকার সভ্যতা আধুনিক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত) মাত্র ২১০/২১১ বছরের মধ্যে কত প্রেসিডেন্ট প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন, কত খুন-খারাবি সে দেশে ঘটেছে এবং এখনও সে দেশে সভ্যতা বিনাশী কি কি কারবার চলছে, তা লেখকের তো জানা থাকার কথা ।

পণ্ডিতদের কোন কোন অজ্ঞতা শুধু লজ্জাজনক নয়, দুঃখজনকও বটে। ইসলামের প্রথম চার খলিফার মধ্যে তিন খলিফা অমুসলিমদের হাতে নিহত হওয়ার কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও চৌধুরী সাহেবরা হত্যার অপবাদটা মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে খ্রিস্টানদের ইতিহাসকে বোধহয় আত্মঘাতি কলহ এবং রক্তপাত থেকে মুক্ত প্রমাণ করতে চান। চৌধুরী সাহেবদের ভাষায় মধ্যযুগ অর্থাৎ মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল শাসনামল বর্বরতার যুগ এবং আত্মঘাতি কলহ এবং খুন-খারাবীর যুগ । সাংস্কৃতিক দাসত্ব বোধহয় একেই বলে!

আমেরিকার সদর-অন্দর : প্রথমে আমেরিকার কথা ধরা যাক। আমেরিকাকে আধুনিক বিশ্বের একটি সুসভ্য দেশ বলা হয়। এ দেশের শাসকদের প্রত্যেকেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। চৌধুরী সাহেবরা আমেরিকাকে বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক সভ্য দেশ বলে অভিহিত করে থাকেন । তারা বলেন, আমেরিকা হচ্ছে ন্যায়-নীতির দেশ, সভ্যতা-সংস্কৃতির দেশ, অত্যাধুনিক শিক্ষা ও বিজ্ঞানের দেশ, সর্বোত্তম আইন-কানুনের দেশ, মানবতাবাদী দেশ এবং পৃথিবীর এক নম্বর সাহায্যদাতা দেশ । এই আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পর্যন্ত ৪০ জন প্রেসিডেন্ট দেশ শাসন করেছেন। মিঃ বুশ ছিলেন একচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট আর বিল ক্লিনটন হচ্ছেন বিয়াল্লিশতম । এই 'সুসভ্য দেশ' 'সুসভ্য' খ্রিস্টান জাতির বাস। তারা নাকি আত্মঘাতি কলহ ও রক্তপাতের ঊর্ধ্বে । কিন্তু এত কড়া আইন-কানুন আর মজবুত নিরাপত্তার দেশে বন্দুকই মার্কিন ইতিহাসের পট পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । একথা কি চৌধুরী সাহেবরা জানেন না? যুক্তরাষ্ট্রের বেয়াল্লিশ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে চারজন নিহত হয়েছেন বন্দুকের গুলিতে স্বধর্মাবলম্বী খ্রিস্টানদের হাতে । এরা হলেন আব্রাহাম লিংকন (শাসনকাল উল্লেখ করা হলো) ( ৪ঠা মার্চ ১৮৬১-১৫ই এপ্রিল ১৮৬৫), জেমস আব্রাম গারফিল্ড (৪ঠা মার্চ ১৮৮১-১৯শে সেপ্টেম্বর ১৮৮১), উইলিয়াম মেক্‌কিনলে (৪ঠা মার্চ ১৮৯৭-১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯০১) এবং জন এফ কেনেডি (২০শে জানুয়ারি ১৯৬১-২২শে নভেম্বর ১৯৬৩)।

১৯৮১ সালের ৩০শে মার্চ প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয় বন্দুকের সাহায্যে। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান একবার তাঁর পত্নীর জন্য একটি বন্দুক কিনেছিলেন । তিনি যখন নির্বাচনী প্রচার অভিযানে বের হতেন, তখন নেন্সি শয্যা পার্শ্বে বন্দুকটি রাখতেন। ১৯৫০ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারী এস ট্রুমেন জনৈক পুয়ের্টোরিক্যান জাতীয়তাবাদীর গুলি থেকে প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেকের সময় আততায়ীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পান ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। ১৯৭৫ সালে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডকে দু'বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। অতীতে শত শত মার্কিন নেতা ও লাখ লাখ মার্কিন নাগরিকের হত্যায় বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছে। নাগরিক অধিকারের নেতা কিং মার্টিন লুথার এই বন্দুকের গুলিতেই নিহত হয়েছেন ১৯৬৮ সালে। জন কেনেডির ভ্রাতা রবার্ট কেনেডি নিহত হন ১৯৬৮ সালে বন্দুকের গুলিতেই।

১৯৮১ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে প্রতিদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬২ জন নাগরিক বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। শুধু ১৯৮০ সালে এক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে নিহত হওয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ১৭ হাজার। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে পরিমাণ মার্কিন সৈন্য নিহত হয়, এ সংখ্যা তার চারগুণ। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে কমপক্ষে ২৫ লাখ আমেরিকান কিশোর পিস্তল, ছুরি, ক্ষুর ও মুগুর জাতীয় অস্ত্র বহন করে নিয়ে যায়। এ খবর পরিবেশন করেছে রয়টার ১৯৯১ সালের ১৭ই নভেম্বর। আমেরিকার সমাজ বিজ্ঞানী, মনস্তত্ববিদ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, সামাজিক সমস্যা কিশোরদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।

তাদের অভিমত : (১) পারিবারিক নির্যাতন : কিশোর ও নাবালকদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের ঔদাসিন্য, তাদের গাল-মন্দ বা মারধর করা। ১৯৮০-৮৭ সালের মধ্যে এই নির্যাতন ১২ লাখ থেকে ২২ লাখে এসে দাঁড়ায়। (২) দরিদ্রতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচটি শিশু-কিশোরের মধ্যে ১ জন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। (৩) সঙ্গী-সাথীদের প্রভাব : শিশু-কিশোর তাদের পিতা-মাতা, গুরুজন ও শিক্ষকদের চাইতে সঙ্গী-সাথীদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় । (৪) অসম্পূর্ণ শিক্ষা জীবন : শতকরা ২৫ জন পড়াশোনা শেষ করার আগেই স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। (৫) অভিভাবকদের গৃহে অনুপস্থিতি : জীবিকার কারণে ৫৪ থেকে ৬৫ শতাংশ অভিভাবক গৃহে অনুপস্থিত থাকেন। বর্তমানে ২৪ শতাংশ কিশোর একক অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। (৬) মাদকদ্রব্য : মাদকদ্রব্য সেবনের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে ।

বিশেষজ্ঞদের মতে অপরাধের কারণগুলো হচ্ছে : অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা শতকরা ৭২, আদালতে কিশোর অপরাধীদের প্রতি দুর্ব্যবহার ৭০, অভিভাবকদের দুর্ব্যবহার ৬৭, চলচ্চিত্র এবং টিভিতে অতিরিক্ত মারদাঙ্গা এবং যৌনতা ৬৭, বিজ্ঞাপনে যৌন আবেদন ৫৭, রক সঙ্গীতে যৌনতা এবং মারদাঙ্গার আবেদন, দরিদ্রতার কারণে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া ৫০ শতাংশ, অপর্যাপ্ত বিনোদনের অভাব ৪২, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব ৩৮ শতাংশ। এ কারণগুলো কিশোরদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অভিমত হচ্ছে মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানীদের (১৫/৬/৮৯)।

১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে শুধু আগ্নেয়াস্ত্রে কিশোরদের মৃত্যুর সংখ্যা আগের চার বছরের মৃত্যুর সংখ্যার অনুপাতে চল্লিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হারের চেয়ে গুলিতে মৃত্যুর হার ১১ শতাংশ বেশি। এ জন্য নিউইয়র্কের ছাত্রদের অনেকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিধান করে ক্লাসে যায় । ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে রয়টার পরিবেশিত খবর ছিল এই : যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হয়। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শহরে যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তার পরিসংখ্যান হচ্ছে এই : নিউইয়র্কে ২২০০, লসএঞ্জেলসে ৯৫৯, হিউস্টনে ৬১৬, ফিলাডেলফিয়ায় ৫১২ এবং ওয়াশিংটনে ৪৩০। অন্যান্য শহরের হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করলাম না।

রয়টার পরিবেশিত ২৪/৪/৯২ তারিখের খবর : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় ১৯শ' মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়ছে। ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৭ হাজার ৬১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৯৯২ সালে ৫৯ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসের খবর : আমেরিকায় ২ কোটি আমেরিকান পুরুষত্বহীন। ১ কোটি লোককে চিকিৎসা করলেও ভালো হবে না। ১ লাখ লোক মাতাল অবস্থায় মারা যায়। ১ কোটি লোক হাঁপানী রোগী । সমকামীর সংখ্যা বেশুমার। ১৯৯০ সালে ৫ লাখ সমকামী মিছিল করেছে নিউইয়র্কে। ২০ লাখ লোক মারিজুয়ানা আর ৫ লাখ হেরোইনসেবী। ১৯৯৪ সালের ২০শে জুলাই ইউএসআই-এর পরিবেশিত খবর ছিল এই, আমেরিকায় প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন মহিলা নির্যাতিত হয়। প্রতি বছর ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ মহিলা তাদের সঙ্গীদের দ্বারা নির্যাতিত হন ।

আমেরিকায় পারিবারিক আত্মকলহে হত্যাকাণ্ড, যৌন কেলেংকারির কারণে হত্যাকাণ্ড আর বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডের যত ঘটনা ঘটে, তা এই পুস্তকে সংকুলান সম্ভব নয়, তবু সংক্ষেপে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। ওয়াশিংটন থেকে ২রা জুলাই ১৯৮২ সালে রয়টার পরিবেশিত খবর ছিল এই, মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন কেলেংকারির অভিযোগ প্রচুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) খবর হলো এই, কয়েকজন কংগ্রেস সদস্যের বিরুদ্ধে বিশ বছরের কম বয়স্ক কংগ্রেস বার্তাবাহক ভৃত্য তরুণ-তরুণীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ রেকর্ড করা হয়েছে। তারা উক্ত তরুণ-তরুণীদের উপহার প্রদান এবং চাকরিতে পদোন্নতির লোভ দেখিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে প্ররোচিত করে থাকেন। সিবিএস টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারী এক ভৃত্য জানিয়েছে, অনেক কংগ্রেস সদস্য ভৃত্যদের কোকেনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য পান করিয়ে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য ওয়েন ছিলেন হেসের সেক্রেটারি। তিনি নিয়মিত মিঃ হেসের বাড়িতে যেতেন এবং মাসিক বেতনের বিনিময়ে তাঁকে দেহ দান করতেন। এ কারণে তাকে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের যৌন কেলেংকারি তো সর্বজনবিদিত এবং বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

চৌধুরী সাহেবদের স্বপ্নের দেশ আমেরিকার আরো কিছু খবর এখানে আমি পরিবেশন করছি। নিউইয়র্ক থেকে ১৯৮২ সালের ৩০শে নভেম্বর রয়টার পরিবেশিত খবর হচ্ছে এই, ১৬ বছর বয়সে পদার্পণের আগেই সে দেশের মেয়েদের কুমারীত্ব লোপের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে তরুণী ভার্যাদের অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্ভোগের হারও আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। প্লেবয় ম্যাগাজিন তরুণ পাঠকদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। নির্ধারিত ১৩৩টি প্রশ্নের জবাব পাঠিয়েছে ম্যাগাজিনের ৮০ হাজার পাঠক, যাদের শতকরা ৮৯ ভাগ পুরুষ। জরিপে বলা হয়, ২১ বছরের নিচের শতকরা ৫৮ ভাগ মেয়ে ১৬ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে একই বয়সের ছেলেদের যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হওয়ার হার হলো ৩৮ ভাগ ।

২১ থেকে ২৯ বছর বয়স্কা বিবাহিতা মেয়েদের শতকরা ৩৫ ভাগ পর পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হওয়ার কথা স্বীকৃত। একই বয়সের বিবাহিত পুরুষরা অন্য নারীর সঙ্গে সহবাসের হার শতকরা ২৫ ভাগ। আজকাল এসব সংবাদে সভ্য জগত বিচলিত হয় না বা অবাকও হয় না। অথচ সমাজের ভিত ধসে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আজ সভ্য দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। ফেডারেল সরকারের হিসেব মতে, জারজ সন্তানের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুতহারে বাড়ছে। এই বৃদ্ধি অব্যাহত, বাড়ছে বৈ কমছে না। সত্তর দশকের শেষ দিকে এই সংখ্যা ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। প্রতি ৬ জনে একজনের জন্ম হয় বিবাহ বন্ধনের বাইরে। ১৯৭৯ সালে ৫ লাখ ৯৭ হাজার অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের তুলনায় এ সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগ বেড়েছে। ১৯৯৩ সালে তা ৮০ ভাগে গিয়ে দাঁড়ায়। দেশব্যাপী শ্বেতাঙ্গ কুমারীদের এক-তৃতীয়াংশের এবং কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীদের শতকরা ৮৩ জনের রয়েছে অবৈধ সন্তান। জন্‌স হপকিস বিশ্ববদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ১৪ ভাগ কুমারী প্রথম সঙ্গমের আগে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ নেয়। কোন কোন মেয়ে অবৈধ সন্তানের মা হওয়াকে পূর্ণতা প্রাপ্তিলাভ বলে মনে করে ।

যৌনাচার, মাদকদ্রব্য সেবন এবং এলকোহলের প্রচুর ব্যবহারজনিত কারণে প্রায় ২ কোটির অধিক আমেরিকান পুরুষত্বহীনতায় আক্রান্ত । এছাড়া আরো লাখ লাখ পুরুষ প্রায়ই এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, এ খবরও রয়টার পরিবেশন করেছে ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে। যৌন সমস্যা সংক্রান্ত গবেষণার একজন অগ্রদূত ডাঃ উইলিয়াম মাস্টারস স্বাস্থ্য বিষয়ক ন্যাশনাল ইনস্টিটউটের এক সেমিনারে এ কথা বলেন। বছরে লক্ষাধিক মার্কিন মাতাল অবস্থায় মারা যায়, এ কথা আগেই বলেছি। ১৯৮৬ সালের ১৯শে এপ্রিল এএফবি পরিবেশিত খবর হচ্ছে এই, ১০ থেকে ১১ বছর বয়স্ক লক্ষাধিক মার্কিন ছেলেমেয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার নেশা করে এবং নয় বছর বয়স্ক শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ মদ্যপানে আসক্ত। জাতীয় কাউন্সিল (এনসিএ) এ তথ্য প্রকাশ করে। এনসিএ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর মাদকাসক্তির কারণে লক্ষাধিক লোক মারা যায় এবং মদজনিত বার্ষিক খরচের পরিমাণ ১৬ হাজার ৬ শত কোটি ডলার। ১৯৮৪ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটন থেকে সিনহুয়া পরিবেশিত খবর হচ্ছে এই, ১০ লাখ আমেরিকান নিয়মিত কোকেন ব্যবহার করে থাকে।

২০ লাখেরও বেশি লোক মাসে কমপক্ষে একবার মারিজুয়ানা সেবন করে এবং ৫ লাখ লোক হেরোইন ব্যবহার করে থাকে। এ জন্য বছরে ব্যয় হয় ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সভ্য আমেরিকায় যৌনাচার এতই প্রবল যে, যৌনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমেরিকার এক শ্রেণীর ছাত্রী সহশিক্ষার বিরুদ্ধে রাজপথে ১৯৯০ সালের মে মাসে মিছিল বের করে। মেয়েদের একটি কলেজে ১৯৯১ সাল থেকে সহশিক্ষা চালু করা হবে এই সিদ্ধান্তের কথা শোনে সে কলেজের ছাত্রীরা রীতিমত বিলাপ, আর্তনাদ ও মরাকান্না জুড়ে দেয়। এ ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ড শহরের মিলস কলেজে ৷ ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকা জানিয়েছে, এই কলেজ সে দেশের গোটা পশ্চিমাঞ্চলের অগ্রণী নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে সুপরিচিত। এই কলেজে পুরুষের অনুপ্রবেশে ক্ষুব্ধ ছাত্রীদের চিৎকারে যেন কলেজ ক্যাম্পাস ডুবে গিয়েছিল। যখন সহশিক্ষার ঘোষণা দেয়া শুরু হয়, তখন সমবেত তরুণীরা কান-ফাটা চিৎকার দিয়ে উঠে। তাদের অনেকে ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ছাত্রী নেত্রীরা ১৩৮ বছরের পুরনো এই কলেজে সহশিক্ষার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বলেন, 'সহশিক্ষার চেয়ে মরণই শ্রেয়'

চৌধুরী সাহেবদের স্বপ্নের দেশ আমেরিকার কিছু সামাজিক দিকও এখানে তুলে ধরছি। ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসের খবর। মার্কিন সাময়িকী ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, আমেরিকা ক্রমেই এমন একটি দেশ হয়ে উঠছে, যেখানে লোকেরা গৃহসংস্থানসম্পন্ন ও গৃহহীন -এই দু'টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে। এমনকি আজও বহু মার্কিন আশ্রয় শিবির এমনসব লোকে ভরপুর, যাদের বাসা ভাড়া পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। এর কারণ হচ্ছে এই, বিগত দশ বছরে বহু ব্যবসায়ী পুরাতন বাড়িঘর কিনে নিয়ে নতুন দালান কোটা তৈরি করেছেন, যেগুলোতে বাস করতো গরীব আমেরিকান। এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত গৃহসংস্থানের ব্যয় কুলিয়ে উঠতে না পারা দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৮৯ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন দাতব্য খাদ্য সংস্থার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এই হিসাব মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ৬০ লাখ লোক বুভুক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম খাদ্য ব্যাংক সেকেন্ড হার্ভেস্ট' এ তথ্য জানিয়েছে (দৈনিক ইনকিলাব ১১/৩/৯৪)।

আলো-আঁধারের দুর্যোগের ঘনঘটার মধ্যেও সভ্য আর অসভ্য লোকের সত্যিকার রূপ বেরিয়ে পড়ে। সভ্য আমেরিকার অসভ্য রূপটা আঁধারের মধ্যেই দেখার অনুরোধ করি চৌধুরী সাহেবদের।

 ১৯৬৫ সালের নিষ্প্রদীপ মহড়ার দুঃস্বপ্ন আর দেখতে হবে না' বলেই নিউইয়র্কবাসীর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সভ্যতার আলোকে উজ্জ্বল এই নগরীতে ১৯৭৭ সালের ১৩ই জুলাই যে দৃশ্য সৃষ্টি হয়, তা কেবল বিস্ময়করই নয়, ভয়াবহও বটে। বৈদ্যুতিক আলোর অনুপস্থিতিতে রাতের অন্ধকারে সভ্যতার মুখোশ পরা মার্কিনরা তাদের সত্যিকার নগ্ন চেহারা-চরিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিল অত্যন্ত প্রকটভাবে ।

১৯৭৭ সালের ১৩ জুলাই রাতে নিউইয়র্ক শহরে আলো ছিল না । এই সুযোগেই নগরীতে অসংখ্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানী, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎ না থাকায় আলো, পানি, এয়ারকুলার এবং পাখা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ চালিত সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় ।

টিভি নেটওয়ার্ক ও সংবাদ সংস্থার কাজও বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর মেয়র আব্রাহাম বীন নিউইয়র্কে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে নগরীতে অতিরিক্ত পুলিশ ও অগ্নিনির্বাপককারী পুলিশও তলব করতে হয়। হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত জেনারেটর স্থাপন করা হয় জরুরি ভিত্তিতে কাজ চালানোর উদ্দেশ্যে। বিদ্যুতের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্ধকারে হাজার হাজার লোক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং নগরীর ১৬টি এলাকায় নির্বিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ।

১৯৬৮ সালে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা কিং মার্টিন লুথার আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর যে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল, ঠিক প্রায় একই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে অন্ধকারাচ্ছন্ন নিউইয়র্ক শহরের ঐসব এলাকাতে। জঙ্গী রূপ ধারণ করে নারী-পুরুষ এমনকি শিশুর দল। বিভিন্ন বারে ঢুকে স্টোর রুমের কপাট ভেঙ্গে চুরমার করার পর প্লেট-গ্লাস নিয়ে যায়। এমনকি জানালা-কপাটসহ যা হাতের কাছে পায়, তা বহন করে নিয়ে যেতে থাকে । যা তারা নিতে পারেনি, তা ভেঙ্গে-চুরে একাকার করে দেয়। প্রথম দিকে কাপড়-চোপড়, টেলিভিশন, মদ ও অলংকারের দোকানগুলোতে হাত দেয়। এসব নিঃশেষ করে খাদ্যজাত দ্রব্য, বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র প্রভৃতির প্ৰতি দৃষ্টি দেয় ৷

বেডফোর্ডের একজন পুলিশ কর্মকর্তা ফ্রাঙ্করস জানান, লুটপাটকারীদের গায়ে যেন প্রচণ্ড জ্বরের ধাক্কা লেগেছিল। তারা ট্রাক ভ্যান নিয়ে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে পড়ে এবং যা কিছু তাতে তোলা সম্ভব হয়েছিল, তাই তারা লুটপাট করে গাড়িতে তুলে। ২টি বালককে ১টি মূল্যবান টেবিল নিয়ে যেতে দেখে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, এই টেবিল তোমরা কোথায় পেলে? একজন বালক সাথে সাথেই জবাব দিল, আমার মা এটা দিয়েছেন, আপনি চাইলে এটা নিয়ে যেতে পারেন। এই বলে তারা জনতার ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এ সময় জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে একটি সাজসরঞ্জামের দোকান ভস্মীভূত হওয়ার দৃশ্য উপভোগ করছিল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত এক ব্যক্তি জানান, লুটপাটের ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ১৯৬৬ সালের ভিয়েতনাম পরিস্থিতির কথাই স্মরণ হচ্ছিল।

ব্রুক্স-এ এসি পল্টিয়াক শো রুমের ইস্পাতের দরজা ভেঙ্গে লুটেরারা প্রবেশ করে এবং ৫০টি গাড়ি নিয়ে যায়। এইসব গাড়ির মূল্য প্রায় আড়াই লাখ ডলার । লুটেরা যুবকেরা দল বেধে মানহাটানের পূর্ব ১৪ নং স্টীটেও নেমে পড়ে। তারা মহিলাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। একদল ১২৫ নং ষ্ট্রীটে (হারলেমের) গোশতের বাজারে হানা দিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে গোশত নিয়ে চম্পট দেয়। মাত্র ১০ বছর বয়সের ২টি বালক ১০৫ নং সড়কে ১টি টিভি নিয়ে টানাটানি করছিল । তখন অপর এক মহিলা ৩টি রেডিও সেট নিয়ে চম্পট দেয় ।

পুলিশ সার্জন রবার্ট মার্ফির ভাষায়, ঐ রজনীতে পশুদের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। তিনি জানান, সবচেয়ে মজার কাণ্ড হলো, আমরা যখন টহল দিয়ে ফিরছিলাম, তখন অনেককেই বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তারা লুটপাট করছিল না বটে, কিন্তু হুইসেল বাজিয়ে লুটপাটকারীদের পুলিশের আগমন সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছিল। আমরা এক জায়গা থেকে দুষ্কৃতকারী দলকে দাবড়িয়ে দিলে তারা ধাওয়া খেয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে লুটপাট শুরু করে। এদিকে অপর একটি দল লুটপাটকারীদের ন্যায় বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ কাজে ব্যস্ত ছিল। অগ্নিনির্বাপনকারীরা ১ হাজার ৩৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিনির্বাপণের চেষ্টা করে। এছাড়া ১ হাজার ৭শ'টি ভুয়া অগ্নিকাণ্ডের সংকেতও তাদের দেয়া হয়। সংকেত পেয়ে ঘটনাস্থল গিয়ে তারা মিথ্যা সংকেত দানের কথা বুঝতে পারে। সাইরেন বাজিয়ে ভিড় ঠেলে অগ্নিনির্বাপণকারী দল ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে দুষ্কৃতকারীরা তাদের ওপর ইট-পাথর মারতে থাকে । ঐ রাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৬৫টি ছিল খুবই মারাত্মক । একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২২ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী আহত হয়। সর্বমোট আহত অগ্নিনির্বাপককারীর সংখ্যা ৫৯ জন ।

একটি মাত্র ঝড় কিছুক্ষণের জন্য হলে সভ্য দেশের সভ্যতার পর্দাকে উন্মোচিত করে আসল চেহারা প্রদর্শন করে। ফলে দেখা যায়, সভ্যতার পর্দার আড়ালে নারকীয় কীটগুলোর কি সোল্লাস কিলবিল। এভাবে এক একটি ঝড় আসে আর পালিশ করা সভ্যতার পর্দাও সরে যায় আর তাতে দেখা যায় আসল চেহারা। চৌধুরী সাহেবরা বাংলাদেশকে সভ্য দেশ বলেন কিনা তা আমি জানি না। তবে এ দেশটিকে যে ভালবাসেন না এবং পছন্দও করেন না, তা বুঝা যায় প্রায় দু'যুগের পলাতক জীবন থেকে। এই বাংলাদেশের রাজধানীতে দিনে-রাতে কতবার যে বিদ্যুৎ থাকে না, তা অনেকটা বেহিসাবের সামিল। বিদ্যুতের অনুপস্থিতে রাতের আঁধারে সভ্য দেশ আমেরিকার মত লুটপাট অগ্নিসংযোগ আর ধর্ষণের মত তাণ্ডব সৃষ্টি হয় না এই বাংলাদেশে বা কোন মুসলিম দেশে ।

পালিশ করা সভ্যতার অন্তরালে অসভ্যতার যে তাণ্ডব সৃষ্টি হয়, এমন আর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৮৩ সালের ১৮ই আগস্ট বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫ম বৃহত্তম শহর হিউস্টনে প্রচণ্ড ঝড় হয়। এই ঝড়ের সময়ে ব্যাপক লুটতরাজ চলে। লুটতরাজের অভিযোগে পুলিশ একশ' ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে । ঝড়ে শত শত দোকানপাটের দরজা-জানালা উড়ে যায়। সুযোগ বুঝে লুটেরারা রাস্তায় নেমে পড়ে এবং লুণ্ঠন চালায়। ১শ' কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতি শুধু ঝড়ের কারণেই হয়। লুটতরাজের ক্ষয়ক্ষতি এই হিসাবের বাইরে । ঝড় শুরু হওয়ার পর রেডক্রসের ৮০টি কেন্দ্রে ২০ হাজার লোক ঘরবাড়ি ত্যাগ করে আশ্রয় নেয়। এই সুযোগেও লুটেরারা তাদের ঘরবাড়িতে লুটতরাজ করে । শহরের সকল পুলিশকে তলব করার পর লুটেরাদের নিবৃত্ত করতে কর্তৃপক্ষের ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল।

টেক্সাস হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য এবং হিউস্টন তারই শহর। ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ-পূর্ব টেক্সাস উপকূল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সে ঝড়ে হিউস্টন শহর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঝড়ের শুরু ও মধ্যম অবস্থায় এবং ঝড়ের শেষে তথাকার সুসভ্য নগর জীবনের যে চেহারা দেখা যায়, তাতে মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এই চেহারা এদের সভ্যতার আসল চেহারা? ঝড়ের আগে আর ঝড় শুরু হওয়ার সময়ে চেহারায় এমন পরিবর্তন অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই ফারাকই বাস্তব। প্রত্যেকটি ঝড় ম্যাকআপ করা সভ্যতা আর তার চাকচিক্য ও জৌলুসকে যেভাবে অপসারণ করে আসল চেহারাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে, তাতে সবক গ্রহণ করার যথেষ্ট উপাদান নিহিত আছে। বিশেষ করে যারা এই সভ্যতার রঙে রঙিন হয়ে সুসভ্য হওয়ার নিত্য মহড়া দেন, তারা এসব দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, যদি ভালো-মন্দ বিচার করার ভেদ-বুদ্ধি লোপ পেয়ে না থাকে ।

অনুন্নত, অর্ধসভ্য এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কতবার বছরে ঝড় হয় আর সপ্তাহে কতবার বিদ্যুৎ চলে যায়, এর কোন হিসেব নেই। দু'তিন দিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তথাকথিত সুসভ্য দেশের মত চৌর্যবৃত্তি, ধর্ষণ আর লুটতরাজের নাটক এসব দেশে মঞ্চস্থ হয় না। কারণ, এসব দেশের ভিতর-বাহির আলাদা করার জন্য মধ্যখানে এখনও মুখোশ-প্রাচীর গড়ে উঠেনি । কৃত্রিম আলো দিয়ে মূল চেহারার কদর্যকে কত দিনই বা ঢেকে রাখা যায়, সেই জিজ্ঞাসার জবাব কি চৌধুরী সাহেবদের থেকে পাওয়া যাবে?

ঝড়ের গতি যত বাড়বে, যতবার ঝড় হবে, ততবারই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হবে। আর ঠিক ততবারই আসল চেহারা ভেসে উঠবে। চৌধুরী সাহেবরা পশ্চিমা দুনিয়ার জাগতিক অগ্রগতি তথা রাস্তাঘাট-দালানকোঠা আর পাউন্ড-ডলারে মুগ্ধ হয়ে ভাবছেন, এটাই সভ্যতা, এটাই সুন্দর আর এটাই সত্য । এই তথাকথিত সত্যকে বরণ করতে গিয়ে নিজ জাতি-গোষ্ঠীকে গালি দেয়া একটা ফ্যাশন হিসাবে ধরে নিয়েছেন। নতুবা দেশ ছেড়ে বিদেশে এভাবে পড়ে থাকতেন না এবং প্রভুদের খুশি করার জন্য সময়ে অসময়ে মুসলমানদের গালিগালাজ করতেন না। এই চৌধুরী সাহেব বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন এবং বাংলাদেশে কমিউনিজমের আদর্শে বাকশালী শাসন-দর্শন চালু করার ব্যাপারে অন্যতম তাত্ত্বিকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন একটি ব্যক্তিগত কারণে। স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য তিনি মস্কো নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত দূতাবাস থেকে দ্রুত ভিসা না পাওয়ায় তিনি ভীষণভাবে মেজাজ খারাপ করেন এবং নিজের কাগজে এই দুঃখের কাহিনী লিখে জাতিকে অবহিত করেন। সেই সময় থেকে সোভিয়েতের প্রতি ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সোভিয়েত প্রোফর্মার বাকশালী ব্যবস্থাকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে হালুয়া-রুটির রেশন বন্ধ হওয়ার কারণে সাবেক প্রভুর দেশে পাড়ি দেন। আজো তিনি সেখানে আছেন। বাংলাদেশের কত বড় প্রেমিক যে তিনি, তা বেশ বুঝা যায় অকারণে পলাতক জীবন বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তে । এমন যাদের জীবন, তাদের পক্ষে স্বধর্ম আর স্বজাতিকে গালি দেয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ, এটাই এই শ্রেণীর মানুষের চাকরি, প্রভুদের আদেশ পালন ও পালনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন।

স্বপ্নের দেশ আমেরিকার অসভ্যতার আর একটি দৃষ্টান্ত পেশ করে আমেরিকা প্রসঙ্গ শেষ করছি। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরের সাপ্তাহিক নিউইয়র্ক টাইমে একটি খবর ও ছবি প্রকাশিত হয়। খবরটি হচ্ছে এই-

As a frequent, but not general practice, certain scenes in U.S.A. films are shot twice- vividly for export and vapidly for American distribution. Producers and directors prefer to deny the habit, Nonetheless, there is such a thing in Holywood films as sex for export only. তারপর পত্রিকাটি Crytough নামক একটি ছবির দু'বারের চিত্র গ্রহণের দৃশ্যের দু'টি আলোক চিত্র পাশাপাশি ছাপিয়ে দেয়। দু'টি চিত্রই শয্যাকক্ষের দৃশ্য। আমেরিকার দর্শকের জন্য যে চিত্রটি প্রদর্শনের কথা, তাতে অভিনেত্রী বস্ত্রাবৃতা অবস্থায় আছেন। কিন্তু বিদেশে রফতানির জন্য যে দৃশ্যটি নেয়া হয় সে দৃশ্যে অভিনেত্রী কালো রংয়ের এক সংকীর্ণ জাঙ্গিয়া পরিহিতা। শরীরের বাকি অংশটুকু কাপড়ের জঞ্জাল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত । এ ধরনের বিবসনা নারী দেহের দৃশ্য বিদেশে চালান দেয়া হয় ।

১৯৮৬ সালের একটি ধর্ষণ মামলা নিউইয়র্কের এক বিচারালয়ে চলছিল। বিচার চলাকালীন এক পর্যায়ে বিচারক বললেন, আমি ধর্ষণকারীকে কিভাবে দোষী সাব্যস্ত করবো, যখন সর্বত্র সেক্সের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। সেক্স সর্বত্র, সেক্স পরিবেশ গোটা সমাজের পরিবেশ, এমন অবস্থা যে সমাজে বিরাজ করছে, সে সমাজে ধর্ষণকারীকে অপরাধী ভাবি কেমন করে?

অবিশ্বাস্য হারে যৌন অপরাধ আমেরিকার সমাজে বৃদ্ধি পাওয়ার মূলে বহু চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা দ্বারা যে ক'টি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে, তাহলো টেলিভিশন আর সিনেমা। হলিউডী ছবির প্রতি ৮টির মধ্যে ১টি ছবি নির্মিত হয় ধর্ষণ ঘটনার চিত্রায়ন করে। ফ্রাইডে দি থাটিয়েত' 'নাইট মেয়ার অন এম স্ট্রিট'-এর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। টেলিভিশন ও যৌনতা ছড়াচ্ছে সর্বত্র। এসবের পরিণতি আজ এই দাঁড়াচ্ছে যে, আমেরিকান সমাজের প্রায় মহিলার ভীতি হয়ে গেছে জীবনের বাস্তবতা' (Fear is a fact of life)আমেরিকার অপরাধ বিজ্ঞানীরা মহিলাদের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা যেন রাতের বেলা শপিং করতে না যান। লাইব্রেরিতে যাতে যান দিনের কর্মব্যস্ত সময়ে। জানালা বন্ধ করে রাতে শোবার পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। মোট কথা, মার্কিন সমাজে নারীরা অধিক হারে নির্যাতিত হচ্ছে দৈহিকভাবে এবং চরিত্রগত কারণে। চৌধুরীদের বিবেচনায় সুসভ্য আমেরিকায় তো বর্ণদাঙ্গা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণদাঙ্গা। ১৯৬৪ থেকে '৯২ পর্যন্ত বর্ণদাঙ্গার খতিয়ান ।

১৯৬৪ : নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউইয়র্ক সিটি ও রচেস্টারের হারলেম ও বেডফোর্ড-স্টাইভেস্যান্ট, নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের জার্সি সিটি, প্যাটারসন ও এলিজাবেথে এবং ফিলাডেলফিয়ায় দাঙ্গা ।

১৯৬৫ : লসএঞ্জেলসের ওয়াটস সেকশন। ন্যাশনাল গার্ড তলব করা হয়। ৩৪ জন নিহত, এক হাজার ৩২ জন আহত, ৩ হাজার ৭৭৫ জন গ্রেফতার এবং ৪ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষতি হয়।

১৯৬৬ : ওয়াটসে দাঙ্গা। ২ জন নিহত, ২০ জন আহত, ৪৯ জন গ্রেফতার ও ১৯টি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয় ।

১৯৬৬ : নেব্রাস্কার ওমাহা, শিকাগো, ক্লেভেলান্ড, ওহিয়ার ডেটন, আটলান্টা ও সানফ্রান্সিকোসহ ৪৩টি নগরীতে সহিংসতা। ১১ জন নিহত, ৪শ' আহত এবং ৩ হাজার গ্রেফতার

১৯৬৭ : নিউ জার্সির নেওয়ার্কে দাঙ্গা। ২৬ জন নিহত, দেড় হাজার আহত, ৩শ'টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ও এক কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন । নিউজার্সির অন্যান্য কমিউনিটিতেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৬৭ : ডেন্টইটে দাঙ্গা। ৪৩ জন নিহত, দুই সহস্রাধিক আহত, ৭ হাজার গ্রেফতার ও ২০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি, ইলিনোইসের কায়রো, নর্থ ক্যারোলিনোর দুরহাম, টেনেসীর মেমফিসে এবং মেরিল্যান্ডের কেম্ব্রিজে বর্ণদাঙ্গা ।

১৯৬৮ : রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে হত্যার পর ১২৫টি নগরীতে সহিংসতা। ৪৬ জন নিহত, ২ হাজার ৬শ' আহত, ২১ হাজার গ্রেফতার ।

১৯৮০ : মায়ামীর লিবার্টি সিটি সেকশনে দাঙ্গা। ১৮ জন নিহত, ৪শ' জনেরও বেশি আহত, ১১শ' গ্রেফতার এবং ১০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন

১৯৮২ : মায়ামীর ওভারটন সেকশন। দু'জন নিহত, ২৫ জনেরও বেশি

আহত ও ৩৮ জন গ্রেফতার।

১৯৮৯ : মায়ামীর ওভারটন সেকশনে দাঙ্গা শুরু হয় । ৬ জন আহত, ৩৫১ জন গ্রেফতার ও ৩০টি ভবন ভস্মীভূত। মোটর সাইকেল চালনারত একজন কৃষাঙ্গকে জনৈক পুলিশ অফিসার গুলি করে হত্যা করলে এই দাঙ্গা শুরু হয়।

১৯৯২ : লসএঞ্জেলসে বর্ণদাঙ্গা। এই দাঙ্গায় ৪৭ জন নিহত, ২ হাজার ১শ'

১৬ জন আহত ও ৫৫ কোটি টাকার সম্পদ ক্রমাগত লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই তো হলো চৌধুরী সাহেবদের মডেল দেশ আমেরিকার সভ্য চেহারা ।

চৌধুরী সাহেব মুসলমানদের ইতিহাস অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও শান্তি ও ঐক্যের কোনো সন্ধান পাননি। শুধু পেয়েছেন নৃশংসতার নজির আর অনৈক্যের ঘটনা। ঢাকার তৎকালীন আন্টাঘরের ময়দানে হাজার হাজার সিপাহীকে ফাঁসিতে লটকিয়ে নাকি হত্যা করা হয় ঢাকার কোন এক নবাবের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। এ ঘটনারও বর্ণনায় তিনি ইংরেজদের কথা ভুলেও উল্লেখ করেননি। তাই জানতে ইচ্ছে হয়, এতই যখন তার ইংরেজ-প্রীতি, তখন তিনি এ কথা বললেও পারতেন যে, এই তো আমি লন্ডন শহরে দু'যুগের অধিককাল ধরে আছি শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। তিনি বর্ণদাঙ্গার উস্তাদদের দেশে বাস করে হানাহানি দেখছেন শুধু মুসলমানদের ।

চৌধুরী সাহেবরা যখন কথা বলেন, তখন বিবেকের সব ক'টি দ্বার বন্ধ করে কথা বলেন । তাই সত্য প্রবেশ করতে পারে না। সত্য প্রবেশ না করার কারণে ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের গায়ে বরাবরই থুথু নিক্ষেপ করে রেশনদাতাদের সত্য ও সুন্দর' বলে নিমকহালালীর প্রমাণ রাখেন। তিনি আন্টাঘর ময়দানের হত্যাকাণ্ডের রেফারেন্স দিলেন, মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, খুনাখুনি আর রক্তপাতের কথা বললেন, কিন্তু যে জাতি এককালে মুসলমানদের এই ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেছে, হাজারো ষড়যন্ত্র করেছে, এই উপমহাদেশে এসে অন্য একটি জাতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে, মুসলমানদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে ধ্বংস করার জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছে, কারাবরণে বাধ্য করেছে, নির্বাসনে পাঠিয়েছে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া বানিয়েছে, সেই জাতির মাতৃ ও পিতৃভূমি বৃটেনে চৌধুরী সুখের জীবন-যাপন করছেন, এতে তাঁর লজ্জা-শরম নেই । যারা নিজ কুলঘাট ছাড়ে, তারা বেশরমই হয়ে থাকে। ইংরেজ জাতির ইতিহাসের পাতা উল্টাবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করি। তাতে তিনি আত্মঘাতী বিরোধ, রক্তপাত এবং অনৈক্যই দেখতে পাবেন পাতায় পাতায়। তখন বলতে বাধ্য হবেন যে, মুসলমানদের ইতিহাসই কম রক্ত-রঞ্জিত। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, তাঁর প্রিয় খ্রিস্টান জাতি গত দু'হাজার বছরে বিশ্বের যত মানুষ খুন করেছে, গত ১৪শ' বছরে মুসলমানদের 'আত্মঘাতী বিরোধ' বা যুদ্ধে সে তুলনায় এক শতাংশ মুসলমানও নিহত হয়নি। চৌধুরী সাহেব ভালভাবে জানেন, একজন অস্ট্রিয়ান আর্ক ডিউক ফার্ডিনান্ডকে একজন সার্বিয়ান খ্রিস্টান হত্যা করেছিল। এ কারণে প্রথম মহাযুদ্ধের সূত্রপাত। সেটা ইতিহাস, কোনও গল্প-কাহিনী নয় । এই খ্রিস্টানরা এতই ভাল মানুষ যে, তাদের নবী যিশু খ্রিস্টকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারেনি। তাঁকে শূলে চড়িয়েছিল। আল্লাহর কালাম পবিত্র ইঞ্জিলকে বিকৃত করেছিল এবং নিজ ধর্মকে তারা অধর্মের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল । নিজ নবীর প্রতি এবং নবীর শিক্ষার প্রতি যাদের এই আচরণ, তাঁরা এই পৃথিবীর যে কত ভাল মানুষ' তা চৌধুরী সাহেবদের বোঝার এখনো বাকি, তা ভেবে আমি বিস্মিত হই। হ্যাঁ, নিমক যখন তাদের খাচ্ছেন এবং তাদের দেশে বাস করছেন, তখন তাদের গায়ে আঁচড় যাতে না লাগে সেভাবে কথা বলতে হবে বৈ কি নবীর গলায় যারা ফাঁসির রশি লাগায়, রক্ত পিচ্ছিল পথে যাদের যাত্রা শুরু, তাদের সম্পর্কে চৌধুরী সাহেবদের সাফাই গাওয়া শোভা পায় না । প্ৰথম মহাযুদ্ধটা মুসলমানরা বাধায়নি, খ্রিস্টানরাই এই মহাযুদ্ধের স্রষ্টা। সেই মহাযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ভারদুনে যে ছয় লাখ লোককে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হয়, এই হত্যাকারী আর নিহতরা উভয় ছিলেন খ্রিস্টান। ঐ হত্যাকাণ্ডকে চৌধুরী সাহেব কি মুসলমানদের আত্মঘাতি বিরোধের ফল' বলবেন? ১৯১৬ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি লোক নিহত হয়, এটাও কি চৌধুরী সাহেব বলবেন মুসলমানদের আত্মঘাতি বিরোধের কারণে? জাপানে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকা আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল, এতে আহত ও নিহত হয়েছিল লাখ লাখ লোক । নিশ্চয়ই তা মুসলমান রাজা-বাদশাহদের কাণ্ড ছিল না। এটি যে আমেরিকার খ্রিস্টান শাসকদেরই কাণ্ড ছিল, তা কি চৌধুরী সাহেব স্বীকার করবেন না? জার্মানদের বোমায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ৭০ হাজার ইংরেজ সিভিলিয়ান নিহত হয় । এটাও কি মুসলিম ভ্রাতৃঘাতী বিরোধের কারণে, না খ্রিস্টান আত্মঘাতী বিরোধের ফলে? চীনের নানকিং দখল করতে গিয়ে জাপান ১ লাখ চীনা সিভিলিয়ানকে হত্যা করে। বলুনতো, এটা কার ভ্রাতৃঘাতী বিরোধের ফল? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পাঁচ কোটি লোক প্রাণ হারায়। বলুনতো চৌধুরী সাহেব, এই পাঁচ কোটি লোকের প্রাণনাশের জন্য কি মুসলমানরা দায়ী? কোরিয়াতে কয়েক বছর যুদ্ধ চালু রেখেছিল কারা? এক কোরিয়াকে দুই কোরিয়ায় ভাগ করল কে? কোরিয়ার যুদ্ধে লাখ লাখ লোক মারা গেল কাদের ষড়যন্ত্রে? জার্মান ভাগ করল কে? বার্লিন বিভক্ত হলো কাদের চক্রান্তে? কাশ্মীরে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে কারা? ফিলিস্তিনি মুসলমানদের বিতাড়ন করে তাদের হত্যা ও নির্যাতন করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো কোন্ মুসলিম রাজা-বাদশাহ? লেবাননে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ জিইয়ে অশান্তির অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে রেখেছে কারা? ইরাক-ইরান এবং ইরাক-কুয়েতের মধ্যে যুদ্ধের দাবানল কে জ্বালিয়েছিল? সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝেড়েছিল কারা? রাশিয়ায় জারের রাজত্বের কথাই বলুন আর লেনিন থেকে গর্বাচেভ পর্যন্ত শাসনামলের কথাই বলুন অথবা স্টালিন কর্তৃক কোটি কোটি লোক হত্যার কথাই বলুন, প্রত্যেকটি ছোট-বড় ঘটনার পিছনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে যদি উত্তর পেতে চাই, তাহলে উত্তর একটিই পাওয়া যাবে আর তা হবে 'খ্রিস্টান', মুসলমান নয়। আজও বিভিন্ন মুসলিম দেশে এই খ্রিস্টানরাই হত্যা ও ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে চৌধুরী সাহেবদের মত লোকদের দ্বারা বিবাদ বাধায়, যুদ্ধ লাগায় আর চৌধুরী সাহেবদের দ্বারাই আবার কাহিনী রচনা করিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে বলে, দেখ দেখ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য নেই, ভ্রাতৃঘাতী বিরোধই প্রকট।

মুসলমানদের মধ্যে মুসলমান নামধারী এক শ্রেণীর আত্মবিক্রিত বুদ্ধি-ব্যবসায়ী আছেন, যারা অল্প পয়সায় কেনা-বেচার পণ্য হতে পারেন । মুসলিম জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টিতে এবং মুসলিম জাতিকে গালি-গালাজে খ্রিস্টানরা তাদের ব্যবহার করে থাকে। আমাদের চৌধুরী সাহেবরা সেই অল্প দামে কেনাবেচার 'মাল'

বৃটেনের সদর-অন্দর : আসুন, আমরা আলোচনা করে দেখি 'ভাল মানুষ' ইংরেজদের ইতিহাস। আমি এখানে রোমানদের অধীনে বৃটেন অথবা সামন্তবাদীদের শাসনাধীন বৃটেন সম্পর্কে কোন কথা বলতে চাই না। কারণ, চৌধুরী সাহেবরা বলবেন, ইংরেজরা তখন ছিল পরাধীন। পরাধীন জাতির ইতিহাস আবার কি হতে পারে? হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তাই যে সময় থেকে রাজাদের রাজত্ব শুরু হয়, সে সময় থেকেই সংক্ষেপে ভাল মানুষ' খ্রিস্টানদের ইতিহাস তুলে ধরছি। এই ধারাবাহিকতার প্রথমেই নাম আসে নরম্যানডির ডিউক প্রথম উইলিয়ামের (১০৬৬-১০৮৭)। উত্তরাঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তিনি হামবার এবং টিজ-এর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকে মরুভূমিতে পরিণত করেন । ইতিহাসে উল্লেখ আছে, পরবর্তী সাতশ' বছর পরেও ধ্বংসের নিদর্শন পরিদৃষ্ট হতো। অসংখ্য লোককে তিনি হত্যা করেন। ফরাসি শহর মেনটেজকেও তিনি ভস্মীভূত করেন। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় উইলিয়াম (১০৮৭-১১০০)-এর রাজত্বকালকে আত্মঘাতি বিরোধ আর রক্তপাতের শাসনকাল বলা যায়। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁরই এক নাইট ওয়ান্টার টাইরেলের দ্বারা তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁর লাশ জঙ্গলেই পড়ে থাকে । কয়েকজন শ্রমিক লাশ পড়ে থাকতে দেখে তা বহন করে নিয়ে আসে এবং বিনা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সমাহিত করে। প্রথম হেনরির (১১০০-১১৩৫) রাজত্বকালও আত্মঘাতি বিরোধের মধ্যদিয়ে কাটে । ফ্লেমবার্ডকে তিনি কারারুদ্ধ করেন। নিজ কন্যা মাতিলদাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করার প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়। গীর্জার সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য তুঙ্গে ওঠে। প্রথম হেনরির মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা সিংহাসনে আরোহণ করার কথা থাকলেও ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি সিংহাসনে বসতে পারেননি। স্টিফেন (১১৩৫-১১৫৪) সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১১৩৮ সালে মাতিলদা সিংহাসন দাবি করে বসেন। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধ ছিল প্রচণ্ড। আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিল না। জনগণ এ অবস্থা দেখে একে অন্যে বলাবলি করতে থাকে, ‘যীশুখ্রিস্ট এবং তাঁর সাথীরা ঘুমিয়ে আছেন।' ১১৪১ সালে স্টিফেন যুদ্ধে পরাজিত হন। মাতিলদা নিজেকে রানী ঘোষণা করেন। কিন্তু তাঁকে কিছু দিন পরই জনগণ লন্ডন থেকে বের করে দেয়। ১১৫৩ সালে মাতিলদার ছেলে ইংল্যান্ডে এসে আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই তো হলো খ্রিস্টান ঐক্যের নমুনা আর স্টিফেনের রাজত্বকাল ।

দ্বিতীয় হেনরি (১১৫৪-১১৮৯) ক্ষমতায় এসে দেখেন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও উপজাতি দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধনে কিছু পদক্ষেপ নেন এবং নতুন ব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। কিন্তু এই ব্যক্তিটি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু টমাস, , বেকেট (Becket)-এর সঙ্গে যে আচরণ করেন, তাতে দ্বিতীয় হেনরির সকল সুনামের ওপর কলঙ্কের আস্তরণ পড়ে। বেকেট ছিলেন তাঁর এত প্রিয় বন্ধু, তাঁকে ছাড়া তিনি এক কদমও আগ-পিছ হতেন না। তাঁকে আর্কবিশপ পর্যন্ত করেছিলেন। হেনরির এই ভালবাসার মধ্যে বেকেট কেমন যেন একটা কৃত্রিমতার ছাপ দেখতে পান। একদিন তিনি বলে ফেলেন, You will soon hate me as much as you love me now. অর্থাৎ তুমি শিগগিরই আমাকে ঘৃণা করবে, যে পরিমাণ তুমি আমাকে এখন ভালবাস । হলোও তাই, একদিন বেকেট চার্চে একটি দাবি নিয়ে দ্বিতীয় হেনরির কাছে আসেন এবং চার্চের প্রতি রাজার নীতির সমালোচনা করেন। বন্ধুর মুখে তার সমালোচনা শুনে তিনি এতই ক্ষুব্ধ হলেন, সাথে সাথেই হুংকার দিয়ে বললেন, Is there none of the cowards eating my bread who will rid me of this turbulent priest ? অর্থাৎ এই কাপুরুষদের মধ্যে আমার নিমকখোর কি কেউ নেই, যে এই অবাধ্য পাদ্রী থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারে? দ্বিতীয় হেনরি-এর কথা উচ্চারণের সাথে সাথে চারজন নাইট বেকেটকে বেধে গীর্জায় নিয়ে যায় এবং সেখানেই তাকে হত্যা করে। এই দ্বিতীয় হেনরি তার রাজত্বে ঐক্যের বটবৃক্ষ সৃষ্টি করাতো দূরের কথা, নিজের সন্তানগুলোকে অনুগত রাখতে পারেননি। সন্তানরা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হেনরি ভগ্নহৃদয় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা নিজেকে উদ্দেশ্য করেই উচ্চারণ করেছিলেন Shame Shame on a conquered king !

গাজী সালাহউদ্দীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় হেনরির দ্বিতীয় পুত্র প্রথম রিচার্ডকে নিয়ে খ্রিস্টান জগত খুবই গর্ব করে থাকে এবং তাঁকে সিংহ দিল রিচার্ড' বলে অভিহিত করে । তিনি যে কত বড় কাপুরুষ ছিলেন, সে কাহিনী ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তিনি গর্ব করে বলতেন, আমি যদি একজন ভাল ক্রেতা পেতাম, তাহলে লন্ডন বিক্রি করে দিতাম । এই রিচার্ড এক খ্রিস্টানের তরবারির আঘাতে নিহত

হন ।

জন (১১৯৯-১২১৬) তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আর্থারের সঙ্গে সিংহাসন নিয়ে কিভাবে কাড়াকাড়ি করেন এবং ১২০২ খ্রিস্টাব্দে রোয়েন নামক স্থানে আর্থারকে কিভাবে হত্যা করেন, তাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ইংল্যান্ডের ব্যারন, চার্চ এবং পোপদের সাথে তাঁর বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছিল। তাঁর আমলে যদিও মেঘনাকার্টার দলিলটি রচিত হয়েছিল, কিন্তু এর কৃতিত্ব তিনি নিতে পারেননি । খুন-খারাবি আর রক্তপাতের দুর্নাম তিনি কুড়িয়েছিলেন। এক যুদ্ধে নদী পাড়ি দেয়ার সময় জন সর্বস্ব হারিয়ে কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তৃতীয় হেনরির (১২১৬-১২৭২) পার্লামেন্টকে বলা হত, পাগলদের পার্লামেন্ট। তাঁর হাত খুন-খারাবি আর রক্তপাত থেকে মুক্ত ছিল না। প্রথম এডওয়ার্ডের (১২৭২-১৩০৭) শাসনকালেও নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও হানাহানির শাসনকাল নামে পরিচিত ছিল। চার্চ এবং ব্যারনদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত । ১২৯৭ সালে পাদ্রীরা রাজাকে ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করে । তিনি ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়ন করেন । কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হননি । দ্বিতীয় এডওয়ার্ড ছিলেন (১৩০৭-১৩২৭) একজন বাচাল ও উদ্ধত ব্যবহারের লোক। পিয়ার্স গেবেস্টন নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে তিনি কিভাবে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তাকে শেষ করেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী রগার মারটিমারকে শূলে চড়ান, তা ইতিহাসে উল্লেখ আছে। তাঁরই আমলে অর্থাৎ ১৩৩৮ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ' শুরু হয়। সেই যুদ্ধ বিভিন্ন বিরতিতে শত বছরই চলেছিল। লোক ক্ষয় হয়েছিল অনেক। দ্বিতীয় রিচার্ড (১৩৭৭-১৩৯৯) ক্ষমতায় এসেই জন উইক্লিফ এবং তার অনুসারীদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হন । এখানে উল্লেখ্য, উইক্লিফ এবং তার কয়েকজন অনুসারী বাইবেলের প্রথম অনুবাদ ইংরেজিতে করেন। তার রাজত্বকালে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। কৃষকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি নিজের সিংহাসনকে কন্টকমুক্ত রাখার জন্য হেরীফোর্ড এবং নরফক এর দু'জন ডিউককে নির্বাসন দেন। কিন্তু তবুও শান্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আয়ারল্যান্ড থেকে ফিরে এসে তিনি দেখেন, তারই এক খালাতো ভাই সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে বসে আছেন। বাধ্য হয়ে

তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এর পরের বছরই আপন লোকের হাতেই নিহত হন তিনি । চতুর্থ হেনরি (১৩৯৯-১৪১৩) ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে পার্লামেন্ট এবং চার্চের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রথমেই উইক্লিফের সমর্থকদের হত্যা করতে থাকেন। তিনি ঘোষণা করেন, চার্চের অনুমোদন ছাড়া যারা ধর্ম প্রচার করবে, তাদের অগ্নিদগ্ধ করে মারা হবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি নিজের শাসনকালকে নিষ্কন্টক রাখতে পারেননি। পঞ্চম হেনরির (১৪১৩-১৪২২) রাজত্বকাল গণবিদ্রোহ আর খুন-খারাবির রাজত্বকাল বলে অভিহিত। তিনজন ধর্ম প্রচারককে হত্যা করে তিনি তাঁর শাসনকাল শুরু করেন। তাঁর সিংহাসনের দাবিদার এক ব্যক্তিকে তিনি লন্ডনের টাওয়ারে বন্দি করে রাখেন। তিনি যাকে সন্দেহ করতেন, তাকেই হত্যা করতেন। আর এভাবেই তিনি মহান শাসক’-এর খেতাব নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ষষ্ঠ হেনরির (১৪২২-১৪৬১) রাজত্বকালে গৃহবিবাদ প্রকট আকার ধারণ করে। ইতিহাসে এই গৃহ বিবাদের নাম Wars of the roses নামে খ্যাত। এ গৃহ বিবাদ ১৪৫৩ সালে শুরু হয় এবং দীর্ঘ দিন চলে । এই যুদ্ধে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। চতুর্থ এডওয়ার্ড, পঞ্চম এডওয়ার্ড এবং তৃতীয় রিচার্ডের শাসনামলও শান্তি ও সুখের ছিল না ।

ইংরেজদের ইতিহাসের যেসব ঘটনা তুলে ধরলাম, তা যদি চৌধুরী সাহেবরা ভুল বলে প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, খ্রিস্টানদের শাসনকালও অনৈক্য, সংঘাত, রক্তপাত, আত্মঘাতী বিরোধ এবং ক্ষমতার কামড়াকামড়ি থেকে মুক্ত নয়।

সপ্তম হেনরি ক্ষমতার মসনদে বসে চতুর্দিকে দেখেন স্বজনদের বিদ্রোহ। বিদ্রোহী স্বজনদের দমন করতে গিয়ে তিনিও রক্তপাত ঘটানোর প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অবলম্বন করেন। অষ্টম হেনরী (১৫০৯-১৫৪৭) ক্ষমতায় বসেই এম্পসন ও ডুডলেককে হত্যা করেন এবং বড় ভাই আর্থারের বিধবা স্ত্রী ক্যাথরিনকে বিবাহ করেন। এ বিবাহের কয়েক বছর পর তিনি এ্যানে বোলিয়ন নামক এক মহিলার প্রেমে পড়েন। ফলে ক্যাথরিনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই বিবাহ বিচ্ছেদের সূত্র ধরে রোম এবং স্পেনের সঙ্গে অষ্টম হেনরির বিবাদের সূচনা ঘটে। এরই সূত্র ধরে তার অতি প্রিয়ভাজন স্যার টমাস মুয়র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ক্রমওয়েলকেও এর জের হিসেবেই প্রাণ হারাতে হয়। ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের (১৫৪৭-১৫৫৩) শাসনকালও শান্তি-স্বস্তির মধ্যদিয়ে কাটেনি । আপন চাচা সোমারসেটকে তিনি কিভাবে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তার শত্রুদের কি নির্মমভাবে দুনিয়া থেকে চিরতরে অপসারিত করেন, সে কাহিনী ইতিহাসে বিধৃত। এডওয়ার্ডের মৃত্যুর খবর কয়েক দিন পর্যন্ত গোপন রেখে লেডী জেইন

গ্রে কিভাবে ষড়যন্ত্র করে সিংহাসনে বসেন এবং পরবর্তী সময়ে তাকে ও তার স্বামীকে টাওয়ারে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়; নর্থাম্বারল্যান্ডের ডিউককে কিভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়; আর এ সুযোগে অষ্টম হেনরির কন্যা মেরী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, সে কাহিনী বড়ই দুঃখজনক । শুধু তাই নয়, ওয়াটের বিদ্রোহ, লেডী জেইন গ্রের মৃত্যুদণ্ড; পাদ্রীদের উপর জুলুম-নির্যাতন এবং ধর্মীয় কারণে কয়েকজন পাদ্রীকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা ইত্যাদি ঘটনার জন্য মেরীর শাসনকাল (১৫৫৩-১৫৫৮) কুখ্যাত হয়ে আছে। মেরীর পর তার সৎ বোন প্রথম এলিজাবেথ ক্ষমতায় আসেন এবং নিজেকে রানী ঘোষণা করেন । তাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৫৫৮-১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ। এলিজাবেথের ৪৫ বছরের শাসনকাল নানা সংকট আর কেলেংকারিতে ছিল ভরপুর। মেরীর শাসনকালে প্রোট্যাষ্ট্যান্টদের কলহ আবার তুঙ্গে উঠে। তারই শাসনকালে হাড্ডি নিয়ে দুই কুকুরের টানাটানি' এ প্রবাদ বাক্যটি সৃষ্টি হয়। এলিজাবেথের রাজত্বকালে মেরীর এক ইতালীয় চাকর জীবিত ছিল। তার নাম ছিল রিজজিও। অজ্ঞাত কারণে লর্ড ডার্নলের নেতৃত্বে কতিপয় ব্যক্তি ঐ লোকটিকে হত্যা করে। এর পরিণামে ডার্নলেককেও হত্যা করা হয়। এলিজাবেথের রাজত্বকালেও অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয় । প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের পিছনে আবিষ্কার করা হত এলিজাবেথকে ক্ষমতার মসনদ হতে উৎখাতের ষড়যন্ত্র'। প্রথম জেমস (১৬০৩-১৬২৫) একইভাবে হত্যা আর রক্তপাতের মধ্যদিয়ে শাসনকাল অতিবাহিত করেন। পিউরিটান পার্টির ক্রমবর্ধমান শক্তি লাভে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জেমসের শাসনকালের প্রায় শুরুতে কেটেসপাই নামক এক রোমান ক্যাথলিকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয়। সেই ষড়যন্ত্রটি ছিল এই, রাজা যখন তার পরিষদ নিয়ে পার্লামেন্টে বসবেন, তখন শক্তিশালী বিস্ফোরক দিয়ে রাজা ও তার পরিষদ এবং পার্লামেন্টকে উড়িয়ে দেয়া হবে । এই লক্ষ্য সামনে নিয়ে হাউস অব লর্ডের ভূগর্ভস্থ একটি কুঠরি বিস্ফোরক দিয়ে ভর্তি করা হয়। গুয়েপাউক নামক এক ব্যক্তিকে অগ্নিসংযোগ করার জন্য মোতায়েন করা হয়। ১৬০৫ সালের ৫ই নভেম্বর এই ঘটনাটি ঘটার কথা ছিল, কিন্তু ষড়যন্ত্রটি ফাঁস হয়ে পড়ে। ষড়যন্ত্রকারী সকলকে হত্যা করা হয়। রাজা জেমস স্যার ওয়াল্টার রেলীকে কিভাবে দীর্ঘ দিন বন্দী রেখে মৃত্যুদণ্ড দেন, সেই ইতিহাসও বড়ই করুণ। তারই শাসনামলে ১৬১৮ সালে ইউরোপের ৩০ বছরের যুদ্ধ' শুরু হয় এবং সে যুদ্ধ উত্তর জার্মানির প্রোট্যাষ্ট্যান্ট এবং দক্ষিণ জার্মানির ক্যাথলিকদের মধ্যেই সংঘটিত হয়। প্রথম চার্লসের (১৬২৫-১৬৪৯) শাসনকালকেও গৃহবিবাদের শাসনকাল বলে অভিহিত করা যায়। বাকিংহামের ডিউককে তিনি হত্যা করেন এবং পার্লামেন্ট ছাড়া দেশ শাসন করেন ১১ বছর। স্ট্যাফোর্ড এবং লাউডকে তিনি হত্যা করেন। ১৬৪২ থেকে ১৬৪৫ সাল পর্যন্ত ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলে। এই গৃহযুদ্ধের জের হিসেবে বিদ্রোহী সেনারা তাকে গ্রেফতার করে এবং শিরশ্ছেদ করে । অতঃপর দেশ শাসনের ধারার পরিবর্তন ঘটে । ১৬৪৯ থেকে ১৬৬০ সাল পর্যন্ত কমনওয়েলথ শাসন নামে এক শাসন প্রবর্তিত হয়, কিন্তু তাও ১৬৬০ সালেই বাতিল হয়ে যায়। ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় চার্লস (১৬৬০-১৬৮৫)। তারই শাসনকালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দু'টি রাজনৈতিক দল হুইগ এবং টোরি নামে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় চার্লসের শাসনকাল কেমন ছিল, এ সম্পর্কে তার মৃত্যুর পর যে কথাটি কিংবদন্তীর মত লোকমুখে উচ্চারিত হত, তা ছিল এই-

Here lies our sovereign lord the king. Whose word no man relies on.

He never said a foolish thing.

And never did a wise one.

অর্থাৎ এখানে শুয়ে আছেন আমাদের মহা প্রতাপশালী রাজা, যার কথায় কেউ বিশ্বাস করতো না। তিনি কখনো বোকার মত কথা বলেননি এবং কখনো তিনি জ্ঞানের একটি কথাও বলেননি।

দ্বিতীয় জেমস (১৬৮৫-১৬৮৮)-এর শাসনামল মনমাউথের বিদ্রোহ দমনের মধ্যদিয়ে কেটে যায়। তারপর উইলিয়াম এবং মেরী (১৬৮৯-১৬৯৪) এবং তৃতীয় উইলিয়াম (১৬৯৪-১৭০২), এ্যানের শাসন কাল (১৭০২-১৭১৪), প্ৰথম জর্জ (১৭১৪-১৭২৭), দ্বিতীয় জর্জ (১৭২৭-১৭৬০), তৃতীয় জর্জ (১৭৬০-১৮২০), চতুর্থ জর্জ (১৮২০-১৮৩০), চতুর্থ উইলিয়াম (১৮৩০-১৮৩৭), ভিক্টোরিয়া (১৮৩৭-১৯০১), সপ্তম এডওয়ার্ড (১৯০১-১৯১০), অতঃপর পঞ্চম জর্জ ও ষষ্ঠ জর্জ থেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের বর্তমান শাসনকাল পর্যন্ত যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, সে ইতিহাস কখনো বিরোধ আর রক্তপাতমুক্ত নয়, ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দেয়। ভিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে দ্বিতীয় এলিজাবেথ পর্যন্ত যারা ইংল্যান্ডেশ্বর আর ইংল্যান্ডেশ্বরী হয়ে ক্ষমতাসীন ছিলেন, তারা বিশ্বের কোটি কোটি লোককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা করেছেন সাম্রাজ্য ঠিক রাখার জন্য। এসব ইতিহাস চৌধুরী সাহেবরা জানেন, কিন্তু বর্তমানে তাঁরা সাবেক প্রভুদের নিমক খাচ্ছেন বলে কোন কথা বলেন না। দোষ দেখেন শুধু মুসলমানদের। বিলেতে বাস করলে রুশদীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করা কারো কারো পক্ষে যে সম্ভব, তা অবশ্য আমরা বুঝি ।

আজ থেকে প্রায় ছয়শ' বছর আগে ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ডের আদি অধিবাসীদের বিতাড়িত করে তাদের স্থলে বহিরাগত প্রেসবাইটোরিয়ানদের বসিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং যুদ্ধ করেও এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকা স্বাধীন হলেও উত্তরাঞ্চলের ৬টি প্রদেশ যুক্তরাজ্যের অধীন থেকে যায়। তখন থেকেই এখানে গোলযোগ নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই এলাকায় বসবাসকারী প্রোট্যাস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে সংহতির প্রচেষ্টা খুব কমই সফল হয়েছে। উক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য পুরো মাত্রায় বিদ্যমান । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ক্যাথলিক ও প্রোট্যাস্ট্যান্ট ছাত্ররা আলাদা ইউনিফরম পরতো। সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রোটাষ্ট্যান্টদের জন্য চাকরি, এমনক ঘর-বাড়িও সংরক্ষিত থাকে। নির্বাচনী এলাকাগুলো এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়, যাতে ক্যাথলিকরা কোন ফায়দা উঠাতে না পারে। অথচ ক্যাথলিকরাই মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এই তো হলো মানবতাবাদী (?) ব্রিটিশ শাসননীতি ।

বর্ণদাঙ্গা : বর্ণদাঙ্গা তো বৃটেনের ঐতিহ্য। ৭০ দশকের শেষ দিকে একবার একটি সচিত্র মিনি পোস্টার লন্ডনের রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে, টিউব স্টেশন ও বাসষ্ট্যান্ডে সেঁটে দেয়া হয়। পোস্টারের চিত্রটি ছিল দাড়িওয়ালা ও পাগড়িধারী শিখের এবং চিত্রের নিচে ক্যাপশন ছিল, They are robbing your money, They are occupying your houses. Drive them out. অর্থাৎ এরা তোমাদের অর্থ লুট করছে, তোমাদের বাড়ি দখল করছে, এদের হটাও। পোস্টার প্রচারকরা এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল এভাবে, এটা একটা সিম্বল (প্রতীক) মাত্র। সকল কালা আদমীর বিরুদ্ধে আমাদের এই অভিযান। এসব অভিযানের অন্যতম উদ্যোক্তা 'ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও স্কীন হেড'-এর নেতা ইনক পাওয়েল স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'বৃটেন বিশ্বে তার সাম্রাজ্য হারিয়েছে, অর্থবিত্ত বা সম্পদ আসছে না। আসছে দারিদ্র্য, অভাব, হতাশা আর কালো আদমীর দল। ওদের ফেরত পাঠাতে না পারলে বৃটেন হবে 'ব্ল্যাক বৃটেন'। ক্ষমতায় আসার পূর্বে টোরী দলের নেত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচারও বলেছিলেন, বহিরাগতদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে বৃটেনের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বৃটেনে বর্ণদাঙ্গার কারণ কোথায় নিহিত, মার্গারেট থ্যাচারের এ উক্তি জানার পর বোধহয় আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না ।

১৯৮১ সালের পরিসংখ্যান দিচ্ছি। লন্ডন থেকে ২রা নভেম্বর (১৯৮১) সিনহুয়া পরিবেশিত সংবাদ ছিল এই, গত বছর বৃটেনে অপরাধের হার বৃদ্ধি পেয়েছে । এ সময় বৃটেনে ও ওয়েলসে প্রায় ৩০ লাখ অপরাধমূলক ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত অপরাধ সংক্রান্ত এক সমীক্ষায় অপরাধমূলক কার্যকলাপ শতকরা দশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। গত দশকের গড় অপরাধের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ । ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে যে সব স্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, পরিসংখ্যানে শুধু তাই দেখানো হয়েছে। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের অপরাধের ঘটনা এখানে দেখানো হয়নি। পরিসংখ্যানে বলা হয়, শতকরা ২০ ভাগ সিঁদেল চুরি, ৩ ভাগ ডাকাতি ও ৮ ভাগ পিস্তলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময় এক লাখ দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। '৮০ সালের তুলনায় এ সংখ্যা শতকরা ৩ ভাগ বেশি। গুরুতর অপরাধ শতকরা ৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংখ্যাও গত দশকের তুলনায় গড়ে তিন গুণ বেশি। এখন ২০০০ সাল। অপরাধ আর দাঙ্গার ঘটনা সে অনুপাতে কত হতে পারে, তা অনুমান করা বোধ হয় কঠিন নয়। কোন মুসলিম বিশ্বে এমন বর্ণদাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে কি?

বৃটেনে গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গরীবরা আরও গরীব হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। বৃটেনে ১৯৮৬ সালের হিসাবেই ১ কোটি ৬৩ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। প্রতি ৮ জনে একজন নিরক্ষর। বৃটেনের যৌন জীবন ধারা আর যৌন কেলেংকারীর কথা নিয়ে আলাদা লেখালেখির কোন প্রয়োজন পড়ে না । কারণ, গোটা দেশই যৌন ভাইরাসে আক্রান্ত । বৃটেনের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এবং তার এককালীন মহিলা সচিবের মধ্যে যৌন কেলেংকারীর যে ঘটনা ঘটে, তা বৃটেনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৬৩ সালে হ্যারল্ড ম্যাকমিলানের সরকারের সময় মন্ত্রী জন প্রফুমো প্রমোদবালা ক্রিস্টিনো কিলারকে শয্যাসঙ্গিনী করলে প্রমোকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে জুনিয়র প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লর্ড লাম্পটনকে পদত্যাগ করতে হয়। কারণ, এক প্রমোদবালার সাথে বিছানায় শুয়ে তিনি ছবি তুলেছিলেন ।

বৃটেনের এমপিরাও যৌন কেলেংকারী ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, এমন ঘটনাও ফাঁস হয়েছে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে। সম্প্রতি বৃটেনে হাউস অব কমন্সের অর্থাৎ পবিত্র সংসদ ভবনের মধ্যে টোরি এমপি ও ক্ষমতাচ্যুত মন্ত্রী মিঃ হার্টিলে বুথ তার গোপন প্রেমিকা নগ্ন মডেল এ্যামিলা বারের সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন খোদ তার প্রেয়সী এ্যামিলা বার। ২২ বছরের সুন্দরী মডেল মিস বার বলেছেন, মিঃ বুথ যৌন কর্মে লিপ্ত হবার আগে খুব তাড়াহুড়ো করেননি। তিনি শুধু গিয়েছিলেন হাউসে ভোট দেয়ার জন্য । ৪৭ বছর বয়সের বিবাহিত ৩ সন্তানের জনক মিঃ বুথ ৪ মাস ধরে এ্যামিলা বারের সাথে যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। মিস বার বলেন, মিঃ বুথ বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে তার বন্ধত্ব ছিল। কিন্তু যৌন সম্পর্ক ছিল না, এটা সত্য নয় । এ কথা মিঃ বুথ নিজেও জানেন।'

মিস বার বলেছেন যে, আমার যৌন সম্পর্কের কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, হিপোক্রেসির কোন অর্থ নেই। অর্ধেক সত্য বলে থেমে যাওয়া হিপোক্রেসিরই সামিল। মিঃ বুথেরও স্বীকার করা উচিত যে, আমাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল।

মিস বার দাবি করেছেন, মিঃ বুথ হাউস অব কমন্সে তার তালাবদ্ধ কামরায় যৌন ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ইইসি-এর কাজে ব্রাসেলসে যাচ্ছেন বলে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে মিঃ বুথ ও মিস বার প্যারিসে রোমান্টিক সপ্তাহের শেষ দিন কাটান। মিস বার আরও দাবি করেছেন, তিনি যখন তাদের গোপন সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করেন, তখন মিঃ বুথ ৪০ হাজার পাউন্ড খরচ করে এক ব্যাংকোয়েট দেন। কমনসভার কেন্দ্রীয় লবির বিপরীত দিকে সার্জেন্ট এট আর্মসের ঘরের কাছে মিঃ বুথের অফিস ঘর। কোন হৈ চৈ নেই । কাজ করার অজুহাতে অনেক দিন তিনি সেখানে থাকতেন। উদ্দেশ্য ছিল, যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া। মিস বার বলেছেন, আমরা সেখানে দরজা বন্ধ করে মিলিত হতাম। যখন সংসদের ডিভিশন বেল বাজতো, তখন মিঃ বুথ ভোট দেয়ার জন্য যেতেন, আবার ফিরে আসতেন। মিস বার বলেন, রাত সাড়ে ন'টার দিকে আমরা মিলিত হতাম। মিস বার মিঃ বুথের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে বলেছেন যে, মিঃ বুথের পরিবারের জন্য আমি দুঃখিত। হাউস অব কমন্সে মিঃ বুথ ও মিস বারের এই অভাবনীয় যৌন কর্মকাণ্ডের খবরে যে কোন লোকেরই মর্মাহত হবার কথা। যে পবিত্র জায়গায় বসে দেশ চালাবার জন্য আইন-কানুন, রীতিনীতি, নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্ব এবং যাদের ওপর জনগণ বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, তারা যদি নৈতিকতা ও সমাজ বিরোধী কাজ করেন এবং আইন অমান্য করেন, তাহলে তাদের কি শাস্তি হওয়া প্রয়োজন-তা তারাই ভাল জানেন। বৃটেনের মিডিয়াতে খবর প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে কেলেংকারির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। সরকার ও দলের মান-ইজ্জত বাঁচানোর জন্য দলীয় নেতাকে নিতে হয় কঠোর ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা হলো, কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও এমপিদের ক্ষমতাচ্যুত করা। অবশ্য এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন নিজ নিজ এলাকার ভোটাররা । (ইনকিলাব ৮/৩/৯৪ ইং)।

ভাল মানুষের দেশের' যে কথা-কাহিনী আর ইতিহাস তুলে ধরলাম, চৌধুরী সাহেবরা তা চ্যালেঞ্জ করার মত কিছু পাবেন বলে আমি মনে করি না। দোষ সকলেরই আছে, কারো কম আর কারো বেশি। মানুষের প্রকৃতিতে দ্বন্দ্ব-কলহের যে সব উপসর্গ আছে, তার প্রকাশ ঘটবেই। যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা তো পারেই। আর যারা নিয়ন্ত্রণে অক্ষম, তারা নানা অঘটন ঘটায়। মানব প্রকৃতিকে যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা না হয়, তাহলে যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা' সব সময় দেখা যায়। তাছাড়াও যদি প্রবাসী তনখাখোরদের ঘাড়ে খ্রিস্টান-ইহুদি ভূত চাপে, রুশদীদের আছর পড়ে, তাহলে তো তারা একতরফা মুসলমানদের দোষ দেখে থাকবেই। দেশে-বিদেশে সেই আছরে আর তাছিরে প্রভাবিত হয়ে চৌধুরীরা আর তসলিমারা নিজ মিল্লাতের দোষ দেখেই চলছেন। ভাড়ায় খাটা বুদ্ধি বিক্রিজীবীরা তাই করে থাকেন। ডায়ানার চরিত্রকে চৌধুরীরা আদর্শ চরিত্র বলে মনে করেন ।

নিজের আয়নায় চৌধুরী : জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী দীর্ঘ ১৮ বছর পর লন্ডন থেকে ঢাকায় এসে বিভিন্ন কাগজে লেখালেখি শুরু করেন এবং ইন্টারভিউ দিতে থাকেন। তাঁর সে সময়ের তাজা লেখায় এবং ইন্টারভিউতে যে সব বক্তব্য আসে, তা ছিল তাঁরই অতীত জীবনের অনেক লেখা ও ভূমিকার বিরোধী। এই স্ববিরোধীতার মুখোশ উন্মোচন করে দৈনিক দিনকালে জনাব আহমদ মুসা ধীরে, গাফফার চৌধুরী, ধীরে' এই শিরোনামে ১৮/১/৯৩, ১৯/১/৯৩, ২৩/১/৯৩, ২৮/১/৯৩ এবং ৪/২/৯৩-এই পাঁচ দিনে তাঁর ধারাবাহিক নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। আমি এখানে এই পাঁচটি নিবন্ধের সারাংশ পাঠকদের জন্য পেশ করছি। এ দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, জনাব চৌধুরী রূপ ও দিক পরিবর্তনে কত পারঙ্গম ।

১৯৭০ সালের ৯ই অক্টোবর, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর মাত্র ৫ মাস আগে, দৈনিক পূর্বদেশ-এর তৃতীয় কলামে শেখ মুজিব সম্পর্কে আপনি (আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী) লিখেছিলেন, ‘সে দিন সহসা আমার চোখের সামনে থেকে একটি বড় যবনিকা সরে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমার চোখের সামনে কল্পনার কোন অসাধারণ নেতা' নন, সেই সাধারণ শেখ মুজিব বসে রয়েছেন । ফিডেল ক্যাস্ট্রো কেন, নাগা নেতা ফিজোর সঙ্গেও যাকে তুলনা করা হাস্যকর। চরিত্রে দক্ষিণপন্থী, নীতিতে সংগ্রাম বিমুখ, কেবল জেল গমন ও চাপ প্রয়োগের আপসবাদী রাজনীতির সেই পুরনো শেখ মুজিব, আড়াই বছরে তার চরিত্রের কিছু বদলায়নি (জেলে থাকার সময়টুকুর কথা বলা হচ্ছে) রাস্তায় নেমে অনেক ভাবলাম, তাহলে এই বাঘ-ছাল গায়ে ছদ্মবেশী সংগ্রামীর ভূমিকা গ্রহণ করা কেন? তরুণ মানসে এই উন্মাদনা সৃষ্টিই বা কেন? গান্ধী-আরউইন চুক্তির মতো তিনিও তো ঘোষণা করলে পারতেন মুজিব-হারুন কিংবা মুজিব-দৌলতানা চুক্তির মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার স্বরাজ আসবে।

কথায় বলে বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া সহজ, নামা বড় কঠিন' । এতদিন বাঘ ছাল গায়ে বিপ্লব ও সংগ্রামী শ্লোগানের বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে শেখ সাহেব বহুবার ঐক্যবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এড়িয়ে চলেছেন। এখন সুযোগ মতো বাঘ-ছাল ফেলে বাঘের পিঠ থেকে নামতে গিয়ে তিনি নিজেই সেই বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন।' একই লেখার আরেক পর্যায়ে তিনি উল্লেখ করেছেন-

১৯৬৬ সালের আগে আমি শেখ মুজিবকে ঘরোয়াভাবে দেখেছি। তারপর আর কাছাকাছি দেখিনি। ১৯৬৭ সালের আগে যে শেখ মুজিবকে চিনতাম, তিনি প্রাদেশিক পরিষদের একজন সাধারণ নেতা, লেখাপড়ায় তেমন নাম নেই । তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কেও বুদ্ধিজীবী মহলে তেমন কোন আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ নেই বরং একটা অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার ভাব রয়েছে।'

কলামের আরেক পর্যায়ে শেখ মুজিবকে কেবলমাত্র ব্যঙ্গ করার জন্যই যেন তিনি লিখেছেন,

১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে দেশে দ্বিতীয় দফা সামরিক আইন জারি হলো। শেখ সাহেব তখন ঢাকায়। শুনলাম তিনি চট্টগ্রাম সফর বাতিল করেছেন । চারিদিকে অসংখ্য প্রত্যাশা-ব্যাকুল মুখে (যে প্রত্যাশা শেখ সাহেব নিজেই সৃষ্টি করেছেন) একটি মাত্র প্রশ্নের গুঞ্জরণ শুনলাম। শেখ সাহেব এখন কি করবেন? তিনি দেশের মানুষকে কি নির্দেশ দেবেন? পর দিন কাগজ উল্টালাম । না কিছু নেই। বিকেলে বহু দিন পর আবার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রাস্তার দিকে এগোলাম । চারদিকে ঝিরঝিরে বিকেলের বাতাস । আমাকে দেখে (শেখ মুজিব) বিমর্ষ হেসে বললেন, আসুন চৌধুরী আসুন। বললাম, ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য নয়, সাংবাদিক হিসেবে এসেছি। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মত কি? শেখ সাহেব বললেন, 'আমি তৈরি হয়ে রয়েছি। আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম, তৈরি হয়ে রয়েছেন কিসের জন্য? তিনি বললেন, 'সুটকেস গুছিয়ে রেখেছি, যদি নিতে আসে, তারা দেখবে আমি তৈরি। জেলের গাড়িতে উঠে পড়বো'। আমি হতাশ কণ্ঠে বললাম, শুধু জেলে গেলেই কি আপনার সব সমস্যার সমাধান? তিনি আগের মতোই নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, 'আর কি করতে পারি? আমি সুটকেস গুছিয়ে তৈরি হয়ে রয়েছি।'

সমসাময়িককালে একটি কথা বাজারে প্রচলিত ছিল যে, শেখ মুজিবকে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের একটি অংশের হাত রয়েছে। এ কথাও প্রচলিত ছিল, আওয়ামী লীগ মার্কিন মদদ পাচ্ছে এবং বাঙালি উঠতি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এগুলোর সত্যতা কতটুকু এই বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে যে, কথিত ধারণাগুলো ব্যাপ্তি লাভ করেছে গাফ্ফার চৌধুরীদের মতো লেখকদের লেখার মাধ্যমে। এ বিষয়ে ১৯৭০ সালের ২রা অক্টোবর লেখা তৃতীয় মত'-এর একটি অংশ তুলে ধরেছি। তিনি তাতে লিখেছেন, 'সম্প্রতি ঢাকার একটি চৈনিক রেস্তোরায় এক উৎসব রজনীর ব্যবস্থা হয়েছিল। আর এই উৎসব রজনীর প্রধান আকর্ষণ ছিল সুস্বাদু চীনা খাদ্য । আওয়ামী লীগ প্রধানের আয়োজিত এই ভোজসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ঢাকার অধিকাংশ পত্রিকার সাংবাদিক। এই অভিজাত হোটেল ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা যোগাযোগ ভেবে নেয়া কষ্টসাধ্য নয়। কারণ, অনেকেই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ উঠতি বুর্জোয়াদের প্রতিষ্ঠান। এই উঠতি বুর্জোয়াদের চোখ উঁচু দিকে, নিদেনপক্ষে এগার তলা হোটেলের বল রুমে গিয়ে ঠেকলে বিস্ময়ের কিছু নেই । তাই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ কোন রাজনৈতিক দলের নেতা যখন আওয়ামী লীগ ও ডলার রাজনীতির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম যোগাযোগ দেখাতে চান এবং নাটকের বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণ কিংবা মিয়া মমতাজ দৌলতানা বা নূর খানকে টেনে আনেন, তখন বিস্মিত হই না।'

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর লেখায় শুধু নিজেই মুজিব বিরোধী মন্তব্য করতেন না, অনেক সময় অন্যের সঙ্গে আলাপের কিছু অংশও তুলে দিতেন তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে। উল্লেখিত কলামের এক পর্যায়ে তাঁর এক বন্ধুর মন্তব্য তুলে ধরেছেন এভাবে, 'নিজে প্রধানমন্ত্রী হলে শেখ সাহেব ডিক্টেটরী মনোভাবের দরুন নিজের হাতে স্বাভাবিক ক্ষমতার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখবেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছেন এই ধুয়া তুলে কাগজে-পত্রে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেখিয়ে পূর্ব বাংলায় এমন জ্বি-হুজুর মার্কা দলীয় মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতায় বসাবেন, যারা ভুলেও কখনো কেন্দ্র ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বাইরে পা ফেলতে সাহস করবেন না।'

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আজকাল লিখে থাকেন, আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবের হাতে একটি সংগ্রাম ও দেশপ্রেমিক দলে পরিণত হয়েছিল (যায়যায়দিন' পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধ দ্রষ্টব্য)। তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশে অন্য কোন দলেরই গণভিত্তি নেই। অথচ ঠিক উল্টা কথা লিখেছেন ১৯৭০ সালের ১৮ ডিসেম্বর 'পূর্বদেশ'-এ। সে দিন তৃতীয় মত'-এর এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, 'পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোন গণভিত্তি নেই বা দলীয় জনপ্রিয়তা নেই । এই দলের একমাত্র মূলধন দলের নেতা শেখ মুজিবের বিপুল জনপ্রিয়তা । শেখ মুজিব যদি আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়াতেন, তাহলে দলের একজন প্রার্থীও ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার জোরে নির্বাচনে জয়ী হতে পারতেন কিনা সন্দেহ।'

আরেক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, 'প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজিত, অপমানিত এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের অর্থ দানে অসমর্থ জার্মান জাতিকে হিটলার ব্রিটিশ বিরোধী তীব্র জাতীয় ভাবাবেগ দ্বারা তার পশ্চাতে জড়ো করেছিলেন এবং আহ্বান জানিয়েছিলেন, তোমরা আমাকে ক্ষমতা দাও, আমি তোমাদের হৃত অধিকার ও মর্যাদা শুধু ফিরিয়েই দেব না, বিশ্বের বুকে জার্মান জাতিকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো।' আমি শেখ সাহেবকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করি না। কিন্তু এবারের নির্বাচনে শেখ সাহেব এই একই কথা অন্যভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে ভোট দেয়ার অর্থই বাংলার স্বাধিকার অর্জন। কেবল ব্যালটের জোরে তিনি পূর্ব বাংলার হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অধিকার ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি গণমানসে যে তীব্র ভাবাবেগ পুঞ্জীভূত হয়েছে, তিনি তাকে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করেছেন। এবারের নির্বাচনেও তাঁর বড় স্লোগান ছিল, 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' এবং 'জয় বাংলা'। বাংলার মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করতে এবং তাঁর ওপর অখণ্ড ও অকুণ্ঠ আস্থা স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে।'

এ পর্যায়ে গাফ্ফার চৌধুরী সংসদীয় ধারায় বিশ্বাসী বামপন্থীদের সমালোচনা করেছেন যে, তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্রোতকে আওয়ামী লীগের মধ্যপন্থী সুবিধাবাদের খপ্পর থেকে মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না এনে জয় বাংলার পরিবর্তে জয় সর্বহারা স্লোগান দিয়েছে।

আরেক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, 'শেখ মুজিবের পশ্চাতে বাংলাদেশের মানুষের সর্বসম্মত সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও তিনি নির্বাচনী যুদ্ধে তাদের সর্বসম্মত রায় পেয়েছেন এবং তাদের আস্থার অধিকারী হয়েছেন। এমন কি যারা তাঁকে বা তাঁর দলকে পছন্দ করেন না, এমন বিপুল সংখ্যক ভোটদাতাও অনন্যোপায় হয়ে তাঁর দলকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছেন । '

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বাপর সময়গুলোতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর লেখায় যা বিশেষভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে, শেখ মুজিব উগ্র জাতীয়তাবাদীদের ওপর নির্ভর করে জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ কোন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ব্যক্তির জনপ্রিয়তাই আসল বস্তু । এ প্রসঙ্গে তাঁর তৃতীয় মত'-এর আরেকটি অংশ তুলে ধরছি, তাতে তিনি লিখেছেন, 'অপর জাতিসত্তার প্রতি প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকাশ্য বিদ্বেষকে কেন্দ্র করে যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ, তার মহাঅকল্যাণকর দিক রয়েছে। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশ এবং তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য কতোটা আগ্রহী ও সংগ্রামী উদ্যোগ গ্রহণের পক্ষপাতী, তা আমি জানি না। আপাতত যে বাঘের পিঠে শেখ মুজিব আরোহী হয়েছেন, তা কিছুটা জাতি-বিদ্বেষকেন্দ্রিক জাতীয়তা। এর হিংস্র নখর এখনো লুক্কায়িত।'

জনাব গাফ্ফার চৌধুরী নিজেই কি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন? যুদ্ধ শুরুর পাঁচ মাস পর ভারতে গিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ পাওয়ার আগে তাঁর ভূমিকা কি ছিল? প্রখ্যাত সাংবাদিক শফিকুল কবির তাঁর 'টিকাটুলী থেকে পিকাডেলী' গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন, '৭০-৭১ সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলকাতায় অবস্থান সম্পর্কে যে ভাষা ব্যবহার করেন, তা প্রকাশযোগ্য নয়... গুণী গাফ্ফার চৌধুরী পূর্বদেশের তৃতীয় মত চাপা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে চতুর্থ কৌশলে বঙ্গবন্ধুর মন জয় করতে পেরেছিলেন (পৃঃ ৪১)। জনাব চৌধুরীর জাদুকরী কলমের ডিগবাজী কিন্তু পরবর্তীকালেও থেমে থাকেনি। ১৯৮৮ সালে ইত্তেফাকের সাংবাদিক শফিকুল কবির লন্ডনে গিয়ে মহা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি সে কথা বর্ণনা করেছেন তাঁর প্রাগুক্ত গ্রন্থে! তিনি লিখেছেন, ‘চা খেতে খেতে খান হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলতে পারেন আপনাদের যশম্বী সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরী আসলে কাদের লোক?'

খানের কথা শুনে আমি নির্বাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম । আমার অবজ্ঞা অনুভব করেই বোধ করি খান বললেন, আপনি যদি গভীরভাবে খোঁজ-খবর নিতে যান, শুনতে পাবেন আওয়ামী লীগ বলছে গাফ্ফার চৌধুরী আমাদের লোক। আওয়ামী লীগ-চ্যুত বাকশাল, যারা আজকে বঙ্গবন্ধু পদক দিচ্ছে তারাও বলছে চৌধুরী আমাদের লোক। লন্ডনে জাতীয় পার্টির কুতুবদের সঙ্গে যদি একান্তে আলাপ করেন শুনবেন তারাও বলছে, এ্যাংগ্রী সিলেটীদের সাইজ আপ করার জন্য আমরাই এই বিশিষ্ট সাংবাদিককে লালন-পালন করে রাখছি। আর বিএনপি'র লন্ডনী নেতারা তো প্রকাশ্যেই বলে বেড়ায়, যে যাই বলুক-গাফ্ফার ভাই আমাদের লোক। (পৃষ্ঠা-৩৯)।

শফিকুল কবিরকে খান আরো বলেন, ‘দেশে তিনি কি ছিলেন আমি বলতে পারব না। তবে লন্ডনে গত চৌদ্দ বছর ধরে তাঁকে দেখছি। এখানেও তাঁর ভক্তের সংখ্যা অনেক। আবার ভক্তরাই পশ্চাতে বদনাম রটায়। (পৃষ্ঠা ৩৯-৪০)।

১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তৃতীয় মতের অধিকারী গাফ্ফার চৌধুরী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট অতিক্রম করে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে ওপারে গিয়ে সুরুত বদল করে ফেলেন। কিন্তু ভাবতে এখনো আমার বিস্ময় লাগে, কত আগাছা-পরগাছা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তালগাছ-শালগাছের রূপ ধারণ করল। কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরীর মতো একজন গুণী লোক কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আশ্রয় পেলেন না। এমনকি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও ঠাঁই হলো না তাঁর। নিন্দুকেরা বলে, হামিদুল হক চৌধুরীর এডভাইসে পাকিস্তানের এজেন্ট হয়ে গাফ্ফার চৌধুরী ইন্ডিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। এই সন্দেহের কারণেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও সেই সময় তাঁকে এড়িয়ে যেত। কিন্তু বাতাস বুঝে নৌকার পাল খাটানোয় ওস্তাদ গাফ্ফার চৌধুরীকে ঠেকায় সাধ্য কার? কলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপে ভগবানের কৃপায়' ঠাঁই পেয়ে গেলেন তিনি। নিন্দুক আর সন্দেহভাজন বন্ধুদের মুখে থাপ্পড় মেরে কলম ঘুরিয়ে ধরলেন অসীম প্রতিভাধর তৃতীয় মতের খ্যাতিমান সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আপসহীন সংগ্রামের কথা মীরা বাঈয়ের ভজনের মতো এমন দরদ দিয়ে আনন্দবাজারে লিখতে থাকেন যে, কলকাতার তুলসীপাতায় উলু উলু ধ্বনির শোর পড়ে গিয়েছিল। তৎকালীন চার ছাত্রনেতার এক নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের পুনর্বাসন ও শনৈ শনৈ উন্নতি সম্পর্কে শফিকুল কবির মিঃ খানের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ‘৭৫-এর ১৫ অগাস্টের পর সেই দাবানলের সময় ইষ্ট লন্ডনে প্রথম শোনা গেল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম। দেশের একজন বড় সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধু খরচপত্র দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করানোর জন্য তাঁকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন সিলেটি কমিউনিটির লীডার মওলানা ভাসানীর আদর্শের পতাকাবাহক তাসাদ্দুক আহমদ ইস্ট লন্ডনে গাফ্ফার চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন । আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, প্রবাসী সিলেটিরা তখন কিভাবে গাফ্ফার চৌধুরীকে আপন করে নিয়েছিল। জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী থেকে শুরু করে দর্জি কারখানার সিলেটি শ্রমিকরা পর্যন্ত গাফ্ফার চৌধুরীর সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা কাতর স্বরে বলতেন আর সিলেটিদের মন গলাতেন। দেশে ফিরে গেলে তাঁর বিপদ হতে পারে, এ কারণ দেখিয়ে লন্ডনে পলিটিক্যাল এসাইলাম চাইলেন, পেয়েও গেলেন। এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে দেশ থেকে তাঁর দুই মেয়ে ও এক পুত্রকেও নিয়ে আসা হলো । তারপর একদিন লন্ডনে ইন্ডিয়ান দূতাবাস থেকে গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে এক সুখবর এল। গাফ্ফার চৌধুরী গেলেন ইন্ডিয়ান দূতাবাসে । প্রথম কিস্তিতে নগদ পাঁচ হাজার পাউন্ড আর দিল্লি থেকে পাঠানো শেখ হাসিনার ছোট্ট একটি চিঠি। চিঠিতে মাত্র কয়েকটি শব্দ লেখা ছিল, 'চাচা, যদি পারেন বাবার স্মৃতিকে লন্ডনে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন।' তারপর ইন্ডিয়ান দূতাবাসের নিয়মিত অর্থ সাহায্যে গাফ্ফার চৌধুরী 'বাংলার ডাক' পত্রিকা প্রকাশ করেন।' (পৃষ্ঠা : ৪১-৪২)। .... গাফ্ফার চৌধুরীর নামের জোরে বাংলার ডাক' ভালই চলছিল ।

কিন্তু বছর দুই পার না হতেই হঠাৎ একদিন 'বাংলার ডাক' বন্ধ হয়ে গেল! এ নিয়ে তখন লন্ডনে নানা কানা-ঘুষা শোনা গেছে। কেউ বলেছে, পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে (হামিদুল হক চৌধুরীর প্রয়োজনে) গাফ্ফার চৌধুরীর গোপন যোগসূত্রের খবর জানার পর ভারতীয় দূতাবাস অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। আবার কেউ বলেছে, পত্রিকায় খারাপ ভাষায় লিখলেও দেশে ফিরে যাবার জন্য জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তৃতীয় সূত্রে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। অতঃপর বাংলার ডাক’-এর হাকডাক নিশ্চুপ হয়ে যায়। (পৃষ্ঠা-৪২)।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশে ফিরে তাঁর দেড় যুগের অজ্ঞতা বা অন্য কোন বিশেষ কারণে' যা লিখে চলেছেন, বাকশাল ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা এগুলো অনেক আগেই বকে ও লিখে গেছেন। বরং এখন সে সব ভুল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। দেশে থেকেও জনগণের মূল স্পন্দনের সঙ্গে যোগাযোগ রহিত বুদ্ধিজীবীদের বাকশালী অংশটি তাদের অক্ষমতাজনিত ঈর্ষাটি মাঝে মাঝে প্রজ্বলিত রাখছেন বটে, কিন্তু তারাও জানেন, প্রকৃত সত্যটি কি । কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরী বাস্তবতার নবতর উপস্থিতি ও বিন্যাসটি উপলব্ধির ধারে-কাছে না গিয়ে পুরনো ব্যবস্থাপত্রটিই দিয়ে যাচ্ছেন জাতিকে, যে ব্যবস্থাপত্রের অনেক ওষুধই বাজারে আর পাওয়া যায় না ।

বাকশাল ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে গাফ্ফার চৌধুরীর অন্তত মিলটি এমনই প্রবল যে, বাংলাদেশে নবপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রটি তার পছন্দ হয়নি। অপছন্দের কারণ চর্চার ত্রুটি নয়, গাফ্ফার চৌধুরীর পছন্দের লোকেরা ক্ষমতায় যেতে পারেননি। অন্তর্জালাটা এখানেই। একদা তিনি বলেছিলেন, সৈনিকের দেশে' তিনি আর ফিরে যাবেন না। ইঙ্গিত করেছিলেন জিয়াউর রহমানকে । সাপ্তাহিক বিচিত্রার ভাষায়, লন্ডনে বসে তখন তিনি লন্ডন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত । কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, এ জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি যখন ক্ষমতায়, তখনই তাঁকে দেশে আসতে হলো। কিন্তু বিএনপি'র সরকারকে যে মেনে নিতে পারেননি, তার প্রমাণ তিনি প্রতিদিনই রেখে চলছেন ।

আমরা জানি না, জনাব চৌধুরীর সাম্প্রতিক মিশনটি কি। স্ববিরোধী, পরস্পর বিরোধী ও জনগণকে অসম্মানিত করে লেখার পেছনকার উদ্দেশ্যটি কি? শফিকুল কবিরের অনুমান, তিনি কোন দূতের আগমনী বার্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শফিকুল কবির তার গ্রাগুক্ত গ্রন্থে আরো লিখেছেন, 'আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং উঁচু দরের ভাড়াটে লেখক। মোশতাক সরকার, জিয়া সরকার এবং হাল আমলের এরশাদ সরকার (১৯৮৮ সালে লেখা, তখন এরশাদ ক্ষমতায়-আ, মু) গাফ্ফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোন হুলিয়া জারি করে রেখেছেন, এমন কোন তথ্য আমার জানা নেই। হামিদুল হক চৌধুরী ও গোলাম আযমের মত বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্রের ব্যক্তিরা দেশে ফিরে এসে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছেন। কিন্তু জোয়ার ভাটার স্রোতধারায় মিশে যাওয়াই যার স্বভাব, সেই চতুর চালাক গাফ্ফার চৌধুরীর দীর্ঘ চৌদ্দ বছরেও কেন দেশে ফিরে আসলেন না। আদৌ ফিরে আসবেন কিনা, ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে কোন তুরুপের তাস হাতে রেখে বাংলাদেশের জ্যাক ধরার আশায় আছেন, এসব অনেক প্রিয়-অপ্রিয় কাহিনী আমি আর বলতে চাই না । (পৃষ্ঠা-৫৩)।

সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সময় গাফ্ফার চৌধুরী লন্ডনে ছিলেন। হত্যার ১১ দিন পর লন্ডন থেকে একটি পাঠানো লেখা জনপদ-এ ছাপা হয় ১৩ই জানুয়ারি। প্রথম পৃষ্ঠায় সিরাজ সিকদারের মৃত্যু এবং তারপর' শিরোনামের লেখায় তিনি লিখেছেন,

লন্ডনে বসেই প্রথমে খবরটা পেয়েছি। রূপকথার নায়ক কমরেড সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে ধৃত হয়ে পলায়ন করার চেষ্টা করায় নিহত হয়েছেন । অনেক প্রবাসী বাঙালির মতো আমিও প্রথমে খবরটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি, এটা একটা পুলিশি স্টান্ট। তারপর ধীরে ধীরে যখন খবরের কাগজে ছবি দেখলাম, আরো খবর শুনলাম, তখন বিশ্বাস করতে হলো- না কমরেড সিরাজ সিকদার আর নেই। পশ্চিমবঙ্গের কমরেড চারু মজুমদার এবং বাংলাদেশের কমরেড সিরাজ সিকদার দু'জনেই একই ভাগ্য বরণ করে নিলেন । অর্থাৎ পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীনই দু'জনকে মৃত্যুবরণ করতে হলো। দু'জনেরই বিপুল সম্ভাবনাময় বিপ্লবী জীবন, কিন্তু দু'জনেরই অবধারিত পরিণতি ব্যর্থতা।'

সিরাজ সিকদারের মত ও পথের সঙ্গে আমি একমত নই। সশস্ত্র বিপ্লবে আমার আস্থা রয়েছে...। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উপকথার যুগের অবসান হলো। জীবিত সিরাজ সিকদারকে আমি দেখিনি । কিন্তু মৃত সিরাজ সিকদারকে আমি শেষ শ্রদ্ধা জানাই।'

অবশ্য গাফ্ফার চৌধুরী তার পরের দিনই আবার সরকারকে ম্যানেজকরার জন্য আরেকটি লেখা ফাঁদেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জানুয়ারি জনপদ-এ তিনি আওয়ামী লীগের জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেন, 'বিদেশে বসে জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে যেমন সমর্থ জানিয়েছি, দেশে এসেও একই কারণে সমর্থন জানাব যে, সরকারের কঠোর হওয়া দরকার। ... আমার প্রার্থনা, বঙ্গবন্ধু এবার যেন সত্যিই কঠোর হন।

শেখ মুজিবকে কঠোর হওয়ার প্রার্থনা জানানোর মাত্র ১০ দিন পর তিনি ক্লান্ত হয়ে গ্রাম্যতা ও বিকারের হাত থেকে মুক্তি চাইলেন। কি বিচিত্র! আজ যখন গাফ্ফার চৌধুরী প্রত্যাখ্যাত বাকশালের গুণকীর্তন করেন, তখন আমাদের ন্যায্য সন্দেহ উপস্থিত হয় যে, এর রহস্য কি?

কিন্তু প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না, পছন্দ করে না শূন্যতা। আঠার বছরে প্রকৃতিই নগ্ন করেছে গাফ্ফার চৌধুরীকে। ঘটনা-তৎপরতার মধ্যদিয়ে প্ৰমাণ করেছে, একজন মেধাবী মতলববাজ ও ভাড়াটে লেখকের স্বরূপ। চাঁদায় যার জীবন চলে তার সমালোচনার অধিকার থাকে না, তাকে সমঝে চলতে হয় পদে পদে। ভেক পাল্টাতে হয় বার বার। জীবিকা যার শ্রমে-ঘামে সিক্ত নয়, সে কখনো সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সত্যের ভান করতে পারে মাত্র। আর যে মস্তিষ্ক ভাড়া খাটে, সে পণ্য করে তোলে সব কিছুকে। তাঁর শ্রদ্ধাকে, ঘৃণাকে, গ্রহণীয়কে, বর্জনীয়কে। তাঁর সত্য সব সময়ই স্বার্থের অনুগামী । গাফ্ফার চৌধুরীর অতুলনীয় মেধা-মনীষা আক্রান্ত হয়েছে সেই স্বার্থের দ্বারা । গাফ্ফার চৌধুরীর ট্রাজেডি এখানেই। কিন্তু তাঁর এই ট্রাজেডি তেমন বড় মাপের ট্রাজেডি নয়, যা দুঃখ-ভারাক্রান্ত করে তুলতে পারে। বরং বড়জোর উদ্রেক করতে পারে করুণার। একটি মহীরুহের পতনকে এভাবেই পর্যবেক্ষণ করছে চলতি বংশধর। যাদের গ্রাম্যতা ও বিকারের কাছে আশ্রয় না নেয়ার জন্য প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেছেন, সম্ভবত তার প্রভু সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি। তাই চৌধুরী কি-ই বা করতে পারতেন।

চৌধুরী শুধু নিজ স্বার্থের স্বজন। যেখানে স্বার্থ নেই, চৌধুরী সেখানে নেই ।

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

পর্ব এক: ভূমিকা

শেষ পর্ব(পাঁচ): সরদার আলাউদ্দিন