শেষ পর্ব(পাঁচ): সরদার আলাউদ্দিন
সরদার আলাউদ্দিন
সিলেট
মুরারী চাঁদ সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন সরদার
আলাউদ্দিন। ১৯৮১ সালের কথা। লেখালেখির হাত ছিল তাঁর। তবে সে হাত ভাল ছিল, না মন্দ ছিল, সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। তিনি স্থানীয়
পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। হঠাৎ তার মনে বাসনা জাগলো, তিনি দেশময় পরিচিত হবেন। এই প্রবল ইচ্ছাটা তাকে অস্থির করে তুললো। তার সামনে
দুটি পথ ছিল খোলা। একটি ছিল সুখ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়টি ছিল কুখ্যাতি
অর্জনের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া। তিনি হয়তো ভাবলেন, প্রথম
পথ বন্ধুর, কঠোর সাধনার পথ, তীব্র প্রতিযোগিতার পথ। এ পথে চলে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। চিন্তার এ
পর্যায়ে শয়তান তার ঘাড়ে সওয়ার হলো। শয়তান তার উপদেষ্টা হলো । অভিশপ্ত শয়তান
তাকে বললো, আলাউদ্দিন, তুমি পারবে না প্রথম পথে চলে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছতে। তুমি দ্বিতীয় পথ ধরো, রাতারাতি তুমি পরিচিত হয়ে উঠবে। তুমি হবে সকলের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব। টক অব দ্য
ন্যাশন হয়ে থাকবে অনেক দিন। ইতিহাসে তোমার নাম ও তোমার কীর্তি অবশ্য কাহিনী আকারে
অন্তর্ভুক্ত হবে।
আলাউদ্দিন
বললেন, ঠিক আছে সে পথই আমি বেছে নেব। কিন্তু এবার বলো, আমাকে কি করতে হবে।
শয়তান
বললো, খুব তাড়াতাড়ি মানুষের মুখে মুখে আর
পত্রপত্রিকায় শিরোনামে আসতে হলে আঘাত হানো কুরআনকে আর মুহাম্মদকে। তৈরি করো একটা
লেখা। সে লেখার নানা আলোচনার ফাঁকে বলে দাও, কুরআন
মুহাম্মদের রচিত । তাহলে জনগণ তোমাকে চিনবার ও দেখবার জন্য অস্থির হয়ে পড়বে।
আলাউদ্দিনের
ভীত বিহ্বল আবেদন, আমার প্রাণনাশের ভয় আছে তাতে।
শয়তানের সাফ জবাব, 'নো রিক্স নো গেইন।'
সরদার
আলাউদ্দিন রাজি হলেন। তিনি রচনা করলেন 'প্রবৃত্তি
ও মহত্ত্ব'
শিরোনামে
এক নিবন্ধ। এই নিবন্ধের এক স্থানে লেখকের মন্তব্য ছিল এই, 'মুহাম্মদ অবস্থা, ব্যবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতি
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়া একখানা পুস্তক রচনা করিয়াছেন, যাহার নাম কুরআন'। এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়
সিলেটের সাপ্তাহিক সমাচারে ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে। এ মন্তব্যের প্রতিবাদ করে
শহরের মুসলিম জনতা ২রা মার্চ (১৯৮১)। পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ করে । প্রথম দিনেই ৫০ জন আহত হয়, ২৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ খবর ছাপা হয়। ৩রা মার্চ
মঙ্গলবার সিলেট শহরে হরতাল পালিত হয় ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
অধ্যাপক সরদার আলাউদ্দিন এতোই কি অজ্ঞ ছিলেন যে, যাকে
তিনি কুরআন রচনাকারী বললেন, তিনি যে লেখাপড়াই জানতেন না, এমনকি নাম দস্তখতও জানতেন না, এ তথ্য ও সত্য কি তার জানা
ছিল না?
সিলেটে
কি ঘটেছিল?
অধ্যাপক
আলাউদ্দিন সরদারের লেখা নিবন্ধটি সিলেট সমাচারে প্রকাশিত হয় ২৪শে ফেব্রুয়ারি
(১৯৮১)। নিবন্ধটি প্রকাশের পর থেকে ১৩ই মার্চ পর্যন্ত সিলেট শহরে প্রায় প্রতিদিন
যে সব ঘটনা ঘটছে, সে সব ঘটনার প্রতিদিনের সংক্ষিপ্ত
বিবরণ ও প্রাসঙ্গিক কথা নিয়ে দৈনিক সংবাদের বিশেষ প্রতিবেদক যে দীর্ঘ প্রতিবেদন
তৈরি করেন, তা উপরোক্ত শিরোনামে দৈনিক সংবাদের
১৫ই মার্চ রোববার (১৯৮১) সংখ্যায় ছাপা হয়। আমি এই দীর্ঘ প্রতিবেদনটি কোন মন্তব্য
ছাড়াই উদ্ধৃত করলাম (লেখক)।
সিলেট
থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সিলেট সমাচার পত্রিকার ২৪শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়
প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পবিত্র কুরআন ও মহানবী (দঃ) সম্পর্কে অশোভন উক্তিকে কেন্দ্র
করে সৃষ্ট আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩ জনের প্রাণহানি, শতাধিক আহত এবং সপ্তাহব্যাপী কারফিউজনিত পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
সিলেট
জেলায় কোন আন্দোলনজনিত কারণে জন জীবনের এরকম অচলাবস্থা সৃষ্টি এর আগে আর কখনো
হয়নি। '৫৪, '৬২, '৬৬ অথবা '৬৯-এর আন্দোলনগুলোতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলেও সিলেটের জনগণের কাছে এত
দীর্ঘ দিনের জন্য কারফিউ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন ।
এই
আন্দোলনের ফলে সরকারিভাবে ৩ ব্যক্তির প্রাণহানির কথা স্বীকার করা হলেও অসমর্থিত
খবর অনুযায়ী প্রাণহানির সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষকালে
গত ২রা ও ৩রা মার্চ গ্রেফতার হয়েছে ৬৯জন। এদের মধ্যে ১৪ জনকে সাথে সাথে মুক্তি
দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে কারফিউ চলাকালে আইন অমান্য করার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন
আরো ২ জন ।
যে
জন্য আন্দোলন : ২৪শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যা সিলেট সমাচার-এর সাহিত্য পাতায় সিলেট
এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সরদার আলাউদ্দিনের
লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘প্রবৃত্তি ও মহত্ত্ব’। নিবন্ধটিতে কুরআন শরীফ ও
মহানবী (দঃ) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
২৭শে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার প্রতিটি মসজিদে এ নিয়ে আলোচনা হয় এবং এই বিষয়টির
ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানোর প্রস্তুতি শুরু হয় ।
সিলেট
সমাচার-এর সম্পাদক এই নিবন্ধটিতে এরকম উক্তি রয়েছে বলে জানতেন না, এ মর্মে কোন কোন মহল মন্তব্য করেন এবং প্রতিবাদ জানানোর প্রস্তুতির সংবাদ শুনে
২৭শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় একপাতার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন। এই বিশেষ সংখ্যার
সম্পাদকীয় নিবন্ধে অজ্ঞাতসারে এই মন্তব্য সম্বলিত নিবন্ধ প্রকাশের জন্য দুঃখ
প্রকাশ এবং আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় ।
২৮শে
ফেব্রুয়ারি দুপুরে সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্রের
একটি মিছিল সিলেট সমাচার কার্যালয় আক্রমণ করে। সেখানে উপস্থিত বশীর আহমদ নামক
একজন সাংবাদিক এ আক্রমণে আহত হন এবং অফিস তছনছ হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানায় একটি
মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই সমাচার কার্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়
।
'ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি' সিলেট
সমাচারের উক্ত নিবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে ২রা মার্চ প্রতিবাদ দিবস আহ্বান করে। তারা
তাদের দাবিমালায় নিবন্ধ লেখক সরদার আলাউদ্দীনের ফাঁসি, সমাচার সম্পাদকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সিলেট সমাচারের প্রকাশনা বন্ধও
অন্তর্ভুক্ত করেন।
১লা
মার্চ বিকেলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এক সভা
আহ্বান করেন। এতে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা
গ্রহণের আশ্বাস দেয়া হয় এবং গৃহীত ব্যবস্থাবলী জনসাধারণের কাছে প্রচারের
ব্যবস্থা করা হবে বলে জানানো হয় । অন্যদিকে প্রতিবাদ দিবসটি শান্তিপূর্ণভাবে
পালনেরও আশ্বাস দেয়া হয় ।
২রা
মার্চের ঘটনা পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী বিকাল ৩টায় স্থানীয় রেজিস্ট্রারি মাঠে
মাওলানা হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ‘ইসলাম
বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি'র প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় নিবন্ধ লেখক সরদার আলাউদ্দীনের ফাঁসি ও সমাচার সম্পাদকের বিরুদ্ধে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, সমাচার-এর ডিক্লারেশন বাতিলসহ
ইসলামী বিরোধী সকল প্রকার কার্যকলাপ বন্ধের দাবি জানিয়ে বক্তৃতা করেন স্থানীয়
সংসদ সদস্য খোন্দকার আব্দুল মালিক, সিলেটস্থ
ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উপপরিচালক অধ্যাপক আফজাল চৌধুরী, পৌর চেয়ারম্যান জনাব বাবরুল হোসেন বাবলু ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ।
প্রতিবাদ
সভা শেষে প্রায় দশ হাজার জনতার একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন
পৌর চেয়ারম্যান জনাব বাবরুল হোসেন বাবলু ও মাওলানা হাবিবুর রহমান প্রমুখ। মিছিলটি
শহর প্রদক্ষিণকালে অংশগ্রহণকারী জনতার সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং দাঙ্গা
দমনকারী পুলিশ ভ্যান থেকে মিছিলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল।
বিকেল
সাড়ে ৪টার দিকে মিছিলকারী জনতা হাসান মার্কেটস্থ কথিত বাসস কার্যালয়ে হামলা
চালায়। হামলায় কার্যালয়টির প্রচুর ক্ষতিসাধন করা হয়। এরপর মিছিলটি
জিন্দাবাজারের দিকে রওয়ানা হলে পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করে। উল্লেখ্য, জিন্দাবাজারের অদূরে তাঁতীপাড়ায় সিলেট সমাচার কার্যালয়। কর্তৃপক্ষ পূর্বেই
তাঁতীপাড়ার সকল রাস্তায় পুলিশের শক্তি বৃদ্ধি করেন।
জিন্দাবাজারে
পুলিশ কর্তৃক মিছিল বাধাপ্রাপ্ত হলে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে
ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এ সময় জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ বেপরোয়া
লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে । উপর্যুপরি কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে
জিন্দাবাজার এলাকায় অন্ধকার নেমে এলেও জনতাকে ঠেকাতে পুলিশকে বেশ নাকানিচুবানি
খেতে হয়। এখানে গুলিবর্ষণেরও শব্দ শোনা যায়, কিন্তু
পুলিশ কর্তৃপক্ষ গুলিবর্ষণের কথা অস্বীকার করেছেন। ঘটনায় প্রথম মৃত্যুবরণকারী
আব্দুল করিম ওরফে দিলীপ আহত হয় জিন্দাবাজারেই । তার দেহে বুলেটের আঘাত ছিল বলে
ডাক্তার অভিমত দেন ।
সংঘর্ষ
চলাকালে জনতা একটি সরকারি জীপে অগ্নিসংযোগ করে। দমকল বাহিনীর গাড়ি আগুন নেভাতে
ছুটে এলে জনতা ঐ গাড়িতেও হামলা চালায় ।
এতে
দমকল বাহিনীর ৬ জন কর্মী আহত হয় । জনতা নিকটস্থ বাংলাদেশ বিমান কার্যালয়েও হামলা
চালায় এবং ক্ষতিসাধন করে ।
সন্ধ্যার
দিকে একশ্রেণীর লোক মিছিলে পুলিশি হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে বন্দরবাজারস্থ
পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। দমকল বাহিনী এখানেও আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়। পরে
বালু পানি দিয়ে পুলিশের লোকরাই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।
রাত
সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শহরের কেন্দ্রস্থলে এভাবে পুলিশ-জনতার সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
পুলিশ এ সময় মিছিল থেকে মোট ২৯ জনকে গ্রেফতার করে । অবশ্য ঐ রাতেই ১৪ জনকে জামিনে
মুক্তি দেয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সংঘর্ষে
২/৩ জন পুলিশের লোকসহ মোট ২৩ জন আহত হয়। এদের মধ্যে আব্দুল করিম ওরফে দিলীপ
মিয়ার অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঐ দিন ভোর সোয়া তিনটায় দিলীপ সিলেট হাসপাতালে মারা
যায়। এদিকে রাতে জেলা প্রশাসন থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১৫ জন পুলিশ আহত এবং
কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের কথা স্বীকার করে বলা হয় যে, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে । তবে পর দিনের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে 'সিলেটের পরিস্থিতি থমথমে' বলে মন্তব্য করা হয় ।
উল্লেখ্য
যে, ঐ দিন বিকাল ৫টা থেকেই শহরের সকল দোকানপাট বন্ধ
হয়ে যায়। জনজীবনে নেমে আসে আতঙ্ক। পাড়ায় পাড়ায় জটলা করে আহত-নিহতের সংখ্যা
নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে আলোচনা ।
এদিকে
জেলা কর্তৃপক্ষ ঐ রাতেই সিলেট সমাচার অফিস সীল, সমাচারের
ডিক্লারেশন বাতিল, সমাচার সম্পাদককে কারণ দর্শাও নোটিশ
জারি ও লেখকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা ঘোষণা করেন।
রাত
সাড়ে ৯টায় জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাইকযোগে ৩রা
মার্চ সিলেট শহরে পূর্ণ হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতাল আহ্বানকারীদের কোন নাম ঘোষণা
করা না হলেও পরে বিরোধী ১২টি রাজনৈতিক দল হরতাল আহ্বানের দায়িত্ব স্বীকার করে।
এদিকে ভোর রাতে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে এক মাইক ঘোষণায়
দাবি মেনে নেয়া হয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়, যা
পরবর্তীতে সিলেট
বেতার
থেকে ঘন ঘন প্রচার হতে থাকে ।
৩রা
মার্চ : গুলিবর্ষণ-কারফিউ : ভোর ছ'টা
থেকেই শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হচ্ছিল। যানবাহন চলেনি, দোকানপাটও খুলেনি। হরতাল চলাকালে খাদ্য উপমন্ত্রী জনাব ইকবাল হোসেন চৌধুরী
সিলেট এসে সার্কিট হাউসে উঠেন ।
সকাল
দশটার দিকে স্থানীয় হাসান মার্কেট পয়েন্টে দশটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ
সাম্যবাদী দলের নেতা জনাব আসাদ্দর আলীর সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়ে
ধর্মপ্রাণ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা করে দোষী ব্যক্তিদের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানান । সভায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে
নিবন্ধ লেখক সরদার আলাউদ্দিনের শাস্তিও দাবি করা হয় ।
বেলা
সাড়ে এগারোটার সময় সুরমা ম্যানসনস্থ পয়েন্টে অপর একটি জনসভায় যখন সংসদ সদস্য
খোন্দকার আব্দুল মালিক, পৌর চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন
বাবুল প্রমুখ বক্তব্য রাখছিলেন, তখন কীন ব্রিজের ওপর থেকে
একটি পুলিশ ভ্যান নিচে নেমে আসছিল। পুলিশ ভ্যানটি সিলেট সমাচার সম্পাদক জনাব
আব্দুল ওয়াহেদ খানকে গ্রেফতার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসছিল। এমন সময় জনসভা
থেকে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক পুলিশ ভ্যানে হামলা চালায়। তারা পুলিশ ভ্যান থেকে
ড্রাইভার ও একজন হাবিলদারকে নামিয়ে নেয়। এ সময় সার্কিট হাউসের আউটার কর্ডনে কীন
ব্রিজের পাদদেশে অবস্থানরত পুলিশ একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে জনতাকে লক্ষ্য করে
প্রথম গুলি ছুঁড়ে। এই গুলিতে ঘটনাস্থলে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নিহত ও ৬ জন আহত
হয়। জনতার হাত থেকে ড্রাইভার ও হাবিলদারকে আহত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে ।
গুলিবর্ষণের
সাথে সাথে সমগ্র শহর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। জনতার ছোট ছোট মিছিলগুলো বিক্ষোভে ফেটে
পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টা শহরে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ চলে, চলে গুলিবর্ষণ। জনতা এক সময় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে
ফাঁড়িটি দখল করে নেয়। পুলিশ অফিস, জেলা
প্রশাসকের বাসভবনে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে ।
বেলা
সাড়ে ১২টার দিকে সারা পৌর এলাকাসহ শহরতলীর কিছু এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য
কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউ জারির কথা ঘোষণা করার পর পরই সমস্ত শহর জনশূন্য হয়ে
পড়ে ।
গুলিবর্ষণে
আহতদের একজন নুরুল আমীন (২৫) ঐ দিনই হাসপাতালে প্রাণ ত্যাগ করেন । লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণের ফলে প্রায় দুশ' লোক আহত হন । এর মধ্যে ৬০
ব্যক্তি সিলেট হাসপাতালে ভর্তি হন। ভয়ে এবং কারফিউজনিত কারণে অনেক আহত ব্যক্তি
হাসপাতালে যাননি। আহতদের মধ্য থেকে ৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদের
প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হয়। সরকারিভাবে ২রা ও ৩রা মার্চের ঘটনায় ৩
জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হলেও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি বলে বিভিন্ন বেসরকারি
মহল দাবি করেন।
রাতে
সার্কিট হাউসে অবস্থানরত খাদ্য উপমন্ত্রী জনাব ইকবাল হোসেনের উপস্থিতিতে জেলা
প্রশাসন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রণয়ন করেন। কিন্তু পর দিন সংবাদপত্রগুলোতে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদত্ত প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। এই প্রেসনোটে বলা হয়, 'সরকার সিলেটে গুলিবর্ষণের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআন ও মহানবী (দঃ) সম্পর্কে আপত্তিকর নিবন্ধ লেখকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু, সিলেট সমাচার-এর সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা
হয়েছে। প্রেসনোটে বলা হয়, উন্মত্ত জনতা সার্কিট হাউস
আক্রমণ করে। খাদ্য উপমন্ত্রী সেখানে ছিলেন। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে
মন্ত্রীর হাউস গার্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়।' অবশ্য জেলা প্রশাসক স্বাক্ষরিত খসড়া প্রেস রিলিজে এ কথা ছিল না। তাই প্রশ্ন
উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ ভাষ্যের সূত্র কি?
৪ঠা
মার্চ : কারফিউকবলিত সিলেট শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা দেখা যায়। যেন জনপ্রাণীহীন মৃত
শহর সিলেট। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত মাত্র ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে
শহরের কাঁচাবাজারে অস্বাভাবিক ভিড় জমে। সমগ্র শহরের মানুষ হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে
আসেন। প্রতিক্রিয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। চালের
দাম ২২৫ থেকে ২৫০ টাকায় ওঠে। মাছ, তরিতরকারী
দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ এবং ঐ দিন ১২টি রাজনৈতিক দল এক
সভা শেষে বিবৃতি প্রকাশ করে । সভায় সংসদ সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও উপস্থিত
ছিলেন। বিবৃতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও হাঙ্গামার প্ররোচণার জন্য বিএনপি নেতা সংসদ
সদস্য খোন্দকার আব্দুল মালিক ও পৌর চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুলকে দায়ী করা
হয়। বিবৃতিতে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, আহত ও নিহতদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দান, গ্রেফতারকৃতদের
বিনা শর্তে মুক্তি, নিবন্ধ লেখকের বিচার এবং কারফিউ
প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় ।
অন্যদিকে
পৌর চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুল ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসনকে দায়ী করে বক্তব্য
রাখেন। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক যথাযথ ব্যবস্থা নিলে
ঘটনার এই পরিণতি হতো না ।
কারফিউ
চলাকালে টহলরত একটি পুলিশের গাড়ি দেখে পালাতে গিয়ে জালাল মিয়া নামক জনতা
ব্যাংকের একজন পিয়ন কীন ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরে সিলেট
হাসপাতালে মারা যান। এই দিন স্থানীয় ঘড়িঘরের নিচে অপর একটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে
দেখা যায়। তবে পুলিশ বলেছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু ।
৫ই
মার্চ : পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এদিন সকাল ১টা থেকে
দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করেন। এদিন সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্ররা একটি
মিছিল বের করে। মিছিলটি শহরে এসেই
ছত্রভঙ্গ
হয়ে যায় ।
সিলেট
পৌরসভা কমিটি ২রা ও ৩রা মার্চের ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসককে দায়ী করে অবিলম্বে
খুনি জেলা প্রশাসকের অপসারণ ও শাস্তি দাবি করে বিবৃতি
প্রদান
করে ।
ঢাকা
থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যথা আওয়ামী লীগ, জামায়াতে
ইসলামী, লেবার পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি বিবৃতি প্রদান করে। একটি ছাত্র সংগঠন ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিলও
বের করে।
জাতীয়
জনতা পার্টি প্রধান জেনারেল (অবঃ) ওসমানী সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে সিলেট
সমাচারকে বিরোধীদলীয় পত্রিকা বলে আখ্যায়িত করে ক্ষমতাসীন দলের একটি মহল এই
পত্রিকাকে বন্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ করেন। তিনি সিলেটের
ঘটনাবলীর জন্য এই মহলের বাড়াবাড়িকে দায়ী করেন ।
৬ই
মার্চ : পরিস্থিতির অধিকতর উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর
আড়াইটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়।
সকাল
থেকেই স্থানীয় বেতারে ১২ জন আলেমের এক বিবৃতি প্রচার করা
হয়।
এই বিবৃতিতে ২রা ও ৩রা মার্চের ঘটনাবলীর জন্য একটি ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধকামী দলের
কার্যকলাপকে দায়ী করা হয় ।
ইসলাম
বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদে মসজিদে নিহতদের রুহের
মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত এবং পরে এক কর্মী সভায় ঘটনার বিচার বিভাগীয়
তদন্ত, আহত-নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারবর্গকে
ক্ষতিপূরণ দান, গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, সিলেট সমাচারে নিবন্ধ লেখক সরদার আলাউদ্দিনের ফাঁসি, সিলেট সমাচার সম্পাদকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সিলেট সমাচারের ডিক্লারেশন
চিরতরে বাতিলের দাবি জানানো হয় ।
সরকার
সিলেটের অতিরিক্ত দায়রা জজ জনাব মোশাররফ হোসেনকে দিয়ে এক সদস্যের একটি বিচার
বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন।
৭ই
মার্চ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত, ৮ই
মার্চ সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত, ৯ই
মার্চ ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ও ১০ই মার্চ ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত
কারফিউ শিথিল করা হয়।
৯ই
মার্চ সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা নিহতদের জন্য গায়েবি জানাযা ও এক
শোকসভার আয়োজন করে। অন্যদিকে ৬ই মার্চ বেতারে প্রচারিত বিবৃতির সাথে
সম্পর্কহীনতার কথা জানিয়ে হাজী কুদরত উল্লাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা জমির উদ্দীন এক
বিবৃতি দেন ।
এদিকে
১০ই মার্চ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে একটি লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়।
জনাব মোহাম্মদ আব্দুর রহিমকে আহ্বায়ক মনোনীত করে গঠিত এই কমিটি নিহত-আহত, ধৃত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নাম-ধাম, পরিচয়
সংগ্রহ এবং তালিকা প্রস্তুত করার কাজে হাত দেন। এই কমিটি বন্দীদের মুক্তি ও কারফিউ
প্রত্যাহারের দাবি জানায় এবং তদন্ত কমিশনের ব্যাখ্যা দাবি করে ।
সিলেট
জেলা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট শহীদ এক বিবৃতিতে পত্রিকায় প্রকাশিত জেনারেল (অবঃ)
ওসমানীর বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলেন যে, সিলেটের
ঘটনার জন্য তিনি বিএনপির ওপর যে দোষারোপ করেছেন, তা
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ।
২রা
ও ৩রা মার্চের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয় । ১১ই মার্চ :
বিরোধী দলের কর্মসূচি : সিলেটের ১২টি বিরোধী রাজনৈতিক দল দুপুর ২টায় স্থানীয়
রেজিস্ট্রারি মাঠে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহতদের উদ্দেশ্যে গায়েবি জানাযার আয়োজন
করে। গায়েবি জানাযা শেষে একটি মৌন মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে।
গ্রেফতারকৃত
৫৫ জন ব্যক্তি আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেন ।
১৩ই
মার্চ : শহর থেকে কার্ফু প্রত্যাহার করা হয় ।
প্রাসঙ্গিক
কথা: আপত্তিকর নিবন্ধ প্রকাশের পর বিশেষ সংখ্যা বের করলেও সিলেট সমাচার-এর প্রতি
জনতার ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ধারণা করা হয়।
প্রকাশিত
হবার পর থেকে সিলেট সমাচার যে ভূমিকা পালন করে আসছে, তাতে
সিলেটের বিভিন্ন মহল এই পত্রিকাটির সাংবাদিকতার নীতিমালা লংঘন করেছে বলে মনে করেন।
বিভিন্ন সময়ে সমাচার ব্যক্তি আক্রোশ মেটানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল বলে এই
মহলের ধারণা। তাছাড়া এই পত্রিকাটি প্রকাশের ইতিহাসও পরিচ্ছন্ন নয়। বিপুল পরিমাণ
সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের মধ্যদিয়ে এই পত্রিকার জন্ম বলে এই মহল অভিযোগ করেছেন।
বাসস-এর
অফিস ও তার ব্যাখ্যা : ১৯৭৪ সাল থেকে সিলেট শহরের হাসান মার্কেটস্থ একটি পরিত্যক্ত
দোকানে বাসস অফিসের সাইন বোর্ড লাগানো হয়। সিলেট সামাচার-এর সম্পাদক আব্দুল
ওয়াহেদ খান তখন সিলেটে বাসস-এর প্রতিনিধিত্ব করতেন। বাসস-এর অফিস হিসাবেই এই ঘরটি
সরকার থেকে বন্দোবস্ত নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে (সমাচার প্রকাশের অনেক পর
এখানে সিলেট সমাচার-এর বাণিজ্যিক কার্যালয়ের সাইন বোর্ড লাগানো হয় ।
৩রা
মার্চের ঘটনার পর সরকারি প্রেসনোটে এই ঘরটিকে বাসস কার্যালয় বলে উল্লেখ করা হলে
বাসস কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানান, সিলেটে
বাসস-এর কোন অফিস নেই এবং সমাচার সম্পাদক ১৯৭৮ সাল থেকে বাসস-এর সাথে কোন
অবস্থাতেই জড়িত নন। প্রতীয়মান হয়, বাসস-এর
সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হবার পর বাসস-এর নামে নেয়া ঘরটি সরকারের কাছে সমর্পণ না করে
নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রয়াস ছিল।
খাদ্য
উপমন্ত্রীর ভূমিকা : ৩রা মার্চ হরতাল চলাকালে খাদ্য উপমন্ত্রী ইকবাল হোসেন চৌধুরী
সিলেট এসে সার্কিট হাউসে উঠেন। প্রথম গুলিবর্ষণের সময় তিনি সার্কিট হাউসে অবস্থান
করছিলেন। পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে তিনি সমস্ত দিন প্রশাসন, বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটির সাথে যোগাযোগ
করেন। তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি সংগ্রামে
সাফল্যের জন্য সন্তোষ প্রকাশ এবং জনগণকে শান্তিপূর্ণ জীবনে ফিরে আসার আহ্বান
জানিয়ে বিবৃতি দেন।
এছাড়া
তিনি টেলিফোনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও যোগাযোগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
আনার প্রচেষ্টা চালান ।
জনমত
: এদিকে সিলেটে ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের
বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের অপসারণ দাবি করেছে বিরোধী দল, বিএনপির কিছু নেতা এবং অন্যরাও। এই মহলের মতে, যথাসময়ে
ঘটনার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলে এই পরিস্থিতি সহজেই এড়ানো যেত ৷
সিলেট
সমাচার ও তার জন্ম কথা : সরকারি ঘোষণার মধ্যদিয়ে যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটির আপাত
দৃষ্টিতে মৃত্যু ঘটলো, সেই পত্রিকাটি প্রথম আবির্ভূত
হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৪ঠা আগস্ট। মাত্র তিন বছর সাত মাস পর এই পত্রিকাটির জীবন শেষ
হয়ে এলো ।
সিলেট
জেলা বোর্ডের একটি প্রেস 'মোজাহিদ প্রেস' প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ষাটের দশকের প্রথম দিকে। এখান থেকে জেলা বোর্ডের মুখপত্র
মাসিক জালালাবাদ ও দ্য সিটিজেন প্রকাশিত হতো। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত জালালাবাদ প্রকাশিত
হয়। দ্য সিটিজেন প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশের কিছু দিন পর ।
১৯৭২
সালের পর এই প্রেসটি জেলা বোর্ড জনৈক নজির আহমদের কাছে বন্দোবস্ত দেন। ১৯৭৫ সাল থেকে
জেলা বোর্ড 'মাসিক শ্যামল' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেও তা ছাপা হতো অন্য প্রেসে ।
১৯৭৬
সালে জেলা প্রশাসক হিসেবে সিলেটে আসেন জনাব মুহম্মদ ফয়েজ উল্লাহ। তিনি 'শ্যামল' প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। উল্লেখ্য, জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে তিনি জেলা বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
কিছু
দিন পর জেলা প্রশাসক মোজাহিদ প্রেসের বন্দোবস্তকারীদের প্রেসটি ফেরত দানের অনুরোধ
জানান। প্রেসটি ফেরত দেয়া হয়। এটাকে তিন বছরের জন্য সিলেট সমাচারের সম্পাদকের
নামে বন্দোবস্ত দেয়া হয় এবং বন্দোবস্ত লাভের পর পরই এখান থেকে সিলেট সমাচার
প্রকাশ শুরু হয়। মোজাহিদ প্রেসের অফিস পরিণত হয় সমাচারের অফিসে। আর মোজাহিদ
প্রেসের নাম পরিবর্তিত হয় 'সমাচার মুদ্রায়ণ'-এ।
প্রথমেই
জেলা বোর্ড থেকে অনুদান হিসেবে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে সমাচার প্রকাশনা শুরু হয়।
পরবর্তীকালে প্রতি বছরই সমাচার জেলা বোর্ড থেকে অনুদান লাভ করতো ।
নতুনভাবে
বন্দোবস্ত লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত জেলা বোর্ড প্রেসের কোন খাজনা পায়নি। উপরন্তু
এই প্রেসটি নাকি সমাচার সম্পাদকের নামে নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তরিত হওয়ারও
প্রস্তাব অনুমোদিত হয়ে আছে ।
'সমাচার'-এ পর্যন্ত জেলা বোর্ড থেকে ১ লাখ ৪
হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে বলে এক হিসাবে জানা গেছে। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের
বিজ্ঞাপনের আনুকূল্য লাভের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেছে।
জেলা
প্রশাসক জনাব ফয়েজউল্লাহর বদলির পর সমাচারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর নাম ছাপা
হতে থাকে প্রতি সংখ্যায় ৷
এই
তিন বছর সাত মাসকালীন সমাচার প্রায় ১ বছর প্রকাশিত হয়েছে সম্পাদকের নামবিহীন
সম্পাদকীয় ছাড়া ২ সপ্তাহ। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেনি অন্তত ৫ বার।
৫০টি খবর অসমাপ্ত অবস্থায় ছাপা হয়েছে। পরবর্তী সংখ্যায় ছাপার ঘোষণা কার্যকর
হয়নি।
বিশেষ
সংখ্যা বের করেছে জেলা প্রশাসক জনাব ফয়েজ উল্লাহর বদলি, মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর সিলেট আগমন, কবি
দিলওয়ার ও যুগভেরী সম্পাদক জনাব আমীনুর রশীদ চৌধুরীর সংবর্ধনা, মহিলা কলেজের ৫০ বর্ষপূর্তি, সিলেটে প্রথম প্রাইজবন্ডের
ড্র এবং সর্বশেষ নিবন্ধ প্রকাশের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। জাতীয় দিবসগুলোতেও
বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। এছাড়া প্রকাশ তারিখের ডেটলাইন ঠিক রেখে পরবর্তী
দিনের খবর প্রকাশ করেছে বেশ ক'টি। এ সময়ে আদালতে মামলা
হয়েছে একটি এবং উকিল নোটিশ পেয়েছে কমপক্ষে তিনটি ।
প্রকাশ, সমাচারের দালান যে জমিতে অবস্থিত তা অর্পিত সম্পত্তি এবং এ জমিও নাকি বৈধভাবে
নেয়া হয়নি। দালানটিও উঠেছে পৌরসভার অনুমতি ব্যতিরেকে ।
সম্পাদকীয়
নীতিমালা হিসেবে কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং স্থানীয়
প্রশাসনের প্রতি সম্পাদকীয় সমর্থন ছিল সুস্পষ্ট আর সিলেটের আঞ্চলিক স্বার্থের
প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন।
উপসংহার
: ২রা ও ৩রা মার্চের ঘটনাবলীকে নিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ধরনের
বক্তব্য নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
বারোটি
রাজনৈতিক দল এই ঘটনাবলীর জন্য বিএনপি নেতা সংসদ সদস্য খোন্দকার আব্দুল মালিক এবং
পৌরসভার চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুলকে দায়ী করেছেন। পক্ষান্তরে বাবরুল হোসেন
বাবুল ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসককে দায়ী করেছেন এককভাবে। ইসলামী ঐক্যফ্রন্ট গঠিত
হয়েছে অন্যদিকে।
প্রথমোক্ত
বারো দলে রয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ, সিপিবি, বাসদ আওয়ামী লীগ (মিজান), সাম্যবাদী দল জাতীয় জনতা পার্টি, একতা
পার্টি, গণতান্ত্রিক পার্টি, ন্যাপ (মোঃ), ওয়ার্কার্স পার্টি ও ইউপিপি। ইসলামী
ঐক্যফ্রন্টে রয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জামায়াতে
ইসলামী, ডেকোক্র্যাটিক লীগ, মুসলিম লীগ ও ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (সিদ্দিকী)। ধর্মীয় অনুভূতি কাজে
লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন এ গোষ্ঠী ।
বিএনপি
নেতারা বলেছেন, ঘটনার জন্য কারা দায়ী তা নির্ধারণ
করবে তদন্ত কমিশন। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত রিপোর্ট ছিল এ পর্যন্তই।
রক্ত
শপথে মহীয়ান তুমি আঠারোই ফাল্গুন আফজাল চৌধুরী
অখণ্ড
বাংলা-আসামের ঐক্য ভূমি গরীয়ান জালালাবাদের পাহাড়-প্রান্তর ও জনপদ হাজার বছরের
তওহীদী ঐতিহ্যের কেন্দ্রস্থল। এখানে বিমুঢ় পৌত্তলিকতার সঙ্গে আলোকজ্জ্বল
তওহীদবাদী ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বে একদা ‘পশু
কোরবানীর অপরাধে' দরবেশ বোরহানউদ্দীনের শিশু সন্তানকে
বলি দেয়া হয় দেবতার পাষাণ বেদীতলে। পৌত্তলিক উন্মত্ত রাজা গৌড় গোবিন্দের
নির্দেশে বোরহানউদ্দীনের ডান হাতও কেটে দেয়া হয় সেই দিন, ধ্বংস করা হয় তাঁর খানকা, উৎখাত করা হয় তাঁর দীনি
তৎপরতা। তাঁকে হাঁকিয়ে দিয়ে তাঁর মুরীদগণকে চড়িয়ে দেয়া হয় শূলে। তওহীদী আলোক
প্রজ্জ্বলনের প্রাথমিক প্রয়াসকে এভাবেই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা ও জাহেলিয়াতের ভীম
প্রহরণে গুড়িয়ে দেবার অপপ্রয়াসে সুরমা, কুশিয়ারার
তীরে তীরে বোরহানের সত্য-সাধনা করুণ কান্নায় অযুত জনতার হৃদয়কে করেছিল ব্যথিত ও
উদ্বেল। প্রাচীন শ্রীহট্টের ঐতিহাসিক জনতা সেই দিন ঘোর আচ্ছন্ন ও তমসাবৃত
রাজশক্তিকে উচ্ছেদের সংকল্প ব্যক্ত করে নির্যাতিত বোরহানের কাটা হাত ছুয়ে বায়েত
গ্রহণ করেছিল । তাঁকে মহান শায়খ হযরত শাহজালাল (রাঃ)-এর দরবারে প্রতিকারের আশায়
পাঠিয়েছিল। ফলে হযরত শাহজালাল (রাঃ) নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে এখানে উত্তোলিত
হয় তওহীদের বিজয় নিশান আর সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলে ঘটে এই
অলৌকিক বিজয়ের প্রতিফলন। তবে আজ, পুঁজিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী
দুই পরাশক্তির দাম্ভিক প্রতিযোগিতায় যখন দুনিয়া প্রতিযোগিতায় বিপর্যস্ত, যখন বিশ্বাসী জনপদসমূহে প্রবেশ করছে অজস্র নেংটি ইঁদুর। জালালাবাদের অলৌকিক
মৃত্তিকাতেও রোপিত হচ্ছে অবিশ্বাসী বৃক্ষের চারা। সহসা এখানে গৌড় গোবিন্দের চেলা
চামুন্ডারা কুৎসিত জাদুমন্ত্রের বলে, পরাশক্তিদ্বয়ের
ইঙ্গিতে যেন কিলবিল করে উঠছে। এদের পৈশাচিক পুনরুত্থান দেখে কাটা হাত নিয়ে মজলুম
বোরহান কি আবার দিগন্তে দণ্ডায়মান হলেন আর সগর্জনে জালালী ফৌজ মাঠ থেকে ঘাট থেকে
ছুটে চলে আসলো আবার,
আবার
যেন-
কাটা
হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মজলুম বোরহান তাঁরা দিল দরিয়ায় মউজ
গৌড়
গোবিন্দের প্রেতাত্মাকে দেয় শত ধিক্কার
আজ
হক জালালী ফৌজ ।
আজ
মাঠ হতে ছুটে আসে কিষাণের দল কাজ ফেলে আসে ভুখা-ফাঁকা মজদুর
আজ
তরুণের তাজা প্রাণ হয় চঞ্চল আকাশে বাতাসে রটে জেহাদের সুর আজ শহীদী রক্তে ঝলসানো
খোশরোজ
যেন
জনতা আজকে আহত বাঘের মত
চোখে
মুখে বুকে নাচে লেলিহান জোশ কেন গৌড় গোবিন্দ হয় এত উদ্ধত
কুফরী
কালামে কেন সে এতই খোশ
জনতা
রাখতে চায় এসবের খোঁজ ॥
চতুর্দশ
হিজরী শতকের বিদায় লগ্নে জালালাবাদের মসৃণ উর্বর মৃত্তিকায় যখন শুভ পঞ্চদশ
হিজরীর খোশ আমদেদ প্রতিধ্বনিত, নব বলে বলীয়ান জনতার বিপ্লবী
চিত্তের গভীরতায় যখন নবজাগরণ উদ্বেলিত, তৃতীয়
বিশ্বের আসন্ন অভিষেকের সম্ভাব্যতাকে পরখ করার হীন উদ্দেশ্যে পবিত্র আল-কুরআনের
ওহী অধিকার নিয়ে তামাশা শুরু করল কতিপয় স্বজাতীয় আত্মবিক্রিত কুসন্তান। জনতা
রুখে ওঠল, ফুঁসে উঠল, ঘরে ঘরে দাওয়াত পৌঁছে
গেল
জেহাদের, আর-
আল-কোরানের
যিল্লতি দেখে রুখে ওঠে মুজাহিদ
জালালাবাদের
গঞ্জে ও শহরে
প্রাণ
বাজী রাখা জঙ্গ-জেহাদে কে হয় আজ শহীদ
সাড়া
জাগে তারি জনতার ঘরে ঘরে।
মনে
হয় যেন হাজার দেড়েক বছর পারায়ে আজ
জনতার
প্রতি টিটকারী দেয়-বেঈমান রংবাজ
জনতার
পাতে তবু সে আহার করে
যাদের
ঈমান আক্বিদার ঘরে উঁকি দেয় শয়তান যাদের পোশাক পরিধান করে লালিত কুসন্তান কোন্
সাহসে সে কালিমা লেপন করে
জনতার
তওহীদী চেতনায় বিজাতীয় জামা পরে ॥
আশ্চর্য
এদের দুঃসাহস! পরাশক্তিদ্বয়ের ইঙ্গিতে নৃত্যরত পুতুলগণের সঙ্গে জনতার আচমকা
পরিচয় ঘটল, সহসাই হল মোকাবিলা। জনতা ছিঁড়ে ফেলল
ওদের মুখোশ। জালালাবাদের মাটিতে বিষবৃক্ষ রোপণের অপপ্রয়াস হল ব্যাহত, ধরা পড়ল বেঈমানে ব্যষ্টি ও সমষ্টিগত রূপ। আসলে এদের রূপ যত বেশি উন্মোচিত হবে
ততই জনতার নিয়তি হবে নিষ্কন্টক। তাই জাতিচ্যুত, সমাজচ্যুত, আত্মধিকৃত এ লোকদেরকে তুমি কি চূড়ান্তরূপে জানলে হে জনতা? তুমি কি জানো, যুগে যুগে ইসলাম বৈরী যিন্দিকের দল
তোমারই নিমক খেয়ে তোমার বুকেই ছোবল হেনেছে? তোমার
সত্তাকে করেছে বিপন্ন, ছিনিয়ে নিয়েছে তোমার জাতীয়
স্বাধীনতা, বিনাশ করেছে তোমার প্রাণপ্রিয় রসূল
(সঃ)-এর খেলাফত! চিনে নাও, খল, ধূর্ত, তোমারই পরগাছা, তাকে চিনে নাও ।
কিন্তু
মুনাফিক গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন হতে না হতেই ওরা জনতাকে চার্জ করে বসলো। শুরু হলো
সংঘর্ষ। বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের ঢলকে বালির বাঁধ দিয়ে রুখবার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হল কিন্তু
বিনিময়ে ফাগুনের রক্ত রাঙা অঙ্গনে, কসবে
সিলেটের ফুটপাতে শাহাদাতবরণ করলেন জঙ্গী মুজাহিদ ভাইয়েরা। যারা জীবনের
হাসি-আহলাদে ছিলেন প্রাণবস্তু, তওহীদী ঐতিহ্যের মহান আদর্শকে
সমুন্নত রাখার তীব্র প্রেরণায় নিজেদের প্রাণসত্তাকে বিলিয়ে দিলেন অনায়াসে। ফলে
যারা শাহাদতের এ মহান দৃশ্য অবলোকন করলেন তাঁদের কাছে এই দৃষ্টান্ত অবিস্মরণীয়
ইতিহাস হয়ে রইল। কি করে রক্তাক্ত ফুটপাতে লুটিয়ে পড়া আমার ঈমানদার ভাইদের
শাহাদাতে এই করুণ ও অবিস্মরণীয় চিত্র আমি
ভুলব?
তুমি
কি বলতে পারো এ কোন বেরসিক তুমি কি জানতে সে এক জঘন্য যিন্দিক?
তোমারই
ঘরে সেতো
দুধ
ভাত খেয়েছে তো
তোমারই
নিমক খেয়ে নিমকহারাম ঘৃণ্য মুনাফিক তুমি আজ যতই চাও
পালিয়ে
সে যে উধাও
তুমি
ভাবো যেদিন হবে তার কিছু তওফিক
বুঝি
সেও হয়ে যাবে তোমার মতই ঠিক ॥
আমি
বলি নয় তা আদৌ
যখনি
পাবে সে দাও
তোমার
বুকে ছোবল দিয়ে যাবে আকস্মিক
স্মরণীয়
তিনশ' ষাট আউলিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরী কারা এই মহাপ্ৰাণ
ভক্তবৃন্দ যারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে উঁচু করল তওহিদী রীতি ও ঐতিহ্যকে? প্রথম বারের মোকাবিলাতেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। একজন নও মুসলিম কিশোর ঈমানের
জ্বলন্ত পরীক্ষায় শহীদ হলো। সে ছিল এক গরিব এতিম কিশোর, নাম আব্দুল করিম দিলীপ। শাহাদতের পেয়ালায় চুমু দিয়ে তার দ্বীন ইসলাম কবুলের
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসকে গভীর তাৎপর্যে রক্তাপ্লুত করে দিল সে । সে কে? চায়ের বাগানের মৃত পিতামাতার সন্তান, অবহেলা
ও লাঞ্ছনার বেড়ে ওঠা অখ্যাত একটি কালো বর্ণের ছেলে, তার
মহান স্রষ্টার সাথে মিলিত হল রক্তলাল অঙ্গরখা পরে। কিন্তু জীবনের রসাস্বাদন থেকে
নিজেকে বঞ্চিত করল বলে প্রিয় নওমুসলিম ভাইটির বিচ্ছেদকে ভুলি কোন্ প্রাণে? কোথায় তারে রাখি, কিভাবে তার শাহাদতের গীত গাই?
নও
মুসলিম ভাই
ইয়াতিম
ছিল সে যে এই দুনিয়ায়
দুঃখী
ছিল হামেশাই
নও
মুসলিম ছিল এক ভাই ।
আঠারোই
ফাল্গুনে সে
সিলেট
শহরের কালো পীচে
রক্তের
শপথে জান লুটালো
আল্লাহ্র
পথে অনায়াসে ।
তারে
কোথায় রাখি
বল
কোথায় রাখি
সে
যে আলোর পাখি
সে
তো আলোর পাখি
শা’জালালের এই জমিনে
এসো
শুইয়ে রাখি তারে
শুইয়ে
রাখি ।
সে
যে কালামপাকের রাহাগীর
সে
যে কাবার পথের মুসাফির
শহীদ
দিলীপ তার নাম
এসো
জিন্দা রাখি তার শির ।
নও
মুসলিম ভাই
কোরান
পাকের রেহাল বুকে নিয়ে
দুনিয়াতে
আজ নাই
নও
মুসলিম ছিল এক ভাই ॥
ভুলতে
পারবো না ভাই আমার ভাইয়ের প্রীতি
আমার
বুকে তুফান তোলে শহীদানের স্মৃতি ফাগুন মাসের কচি কচি পাতার মত যারা
একটি
পাতা দু'টি কুঁড়ির স্বপ্নে ছিল হারা
জীবন
দিয়ে উঁচু করল তওহীদেরই রীতি ॥ তিনশ ষাট আউলিয়ার দেশে এদের রক্তধারা
মরুপথে
হারাবে এই কথা ভাবেন যারা তারা যতই বলুন এসব আপন ভোলা নীতি
আঠারোই
ফাগুন এলে নিজেই হব স্মৃতি
গাইব
আমি জীবন ভর এই শাহাদতের গীতি ॥
প্রাণোদ্বেল
আঠারোই ফাল্গুন ছিল সে দিনটি। আপন ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের বজ্র শপথে নিষ্কাশিত
উজ্জ্বল তরবারি সদৃশ এই ক্ষমাহীন দিনে শহীদ আব্দুল করিমের প্রথম কোরবানীতে জনতার
বিজয় ঘোষিত হয়ে গেল। ঐতিহ্যমণ্ডিত জালালাবাদের অলৌকিক মৃত্তিকায় ঐ দিনটি
মানবজাতির ধর্মাধিকার আদায়ের প্রতীকি দিবস রূপে আশ্চর্য মর্যাদা লাভ করল । ১লা মে
যে রূপ শ্রম অধিকার, ফেব্রুয়ারি যেমন মাতৃভাষার অধিকার
আদায়ের জন্য ৮৭ বঙ্গাব্দের আঠারোই ফাল্গুন তেমনি এ দেশবাসীর ধর্মাধিকার সংরক্ষণের
জন্য সুচিহ্নিত হল আমাদের চেতনায়।
রক্ত
শপথে মহীয়ান তুমি
আঠারোই
ফাল্গুন
আঠারোই
ফাল্গুন
অভিশাপ
পদদলনের দিন
আঠারোই
ফাল্গুন
আঠারোই
ফাল্গুন ।
জালালাবাদের
আত্মশক্তি
জাগ্রত
যেই দিন
লাখো
তরুণের বজ্র শপথে
সংহত
সেই দিন
বহু
শহীদের রক্তে রাঙানা
জ্বলন্ত
সে আগুন
আঠারোই
ফাল্গুন ॥
ধর্মের
পথে শহীদের ত্যাগ
ব্যর্থ
হয় না জানি
ব্যর্থ
হবে না তোমার
আমার
পরমাত্মীয় বাণী
ঝরাতে
হবে না ফুটপাতে
আর
হৃদয়ের তাজা খুন
আঠারোই
ফাল্গুন । মানবাধিকারে গরীয়ান
তুমি
আঠারোই ফাল্গুন আঠারোই ফাল্গুন
ধর্মাধিকার
আদায়ের দিন
আঠারোই
ফাল্গুন
আঠারোই
ফাল্গুন ॥
তবে
বিশ্বজনীন সত্য ধর্মের সংরক্ষক স্বয়ং আল্লাহ। তাঁর প্রদর্শিত পথে তাঁরই প্রিয়
বান্দাদের কোরবানী তিনিই কবুল করেন। যদি এ মহান গণবিস্ফোরণের মহা আবেগ মাবুদের
কাছে গৃহীত হয়ে থাকে তবেই জালালাবাদের বিপ্লবী জনতা তথা সমগ্র বিশ্ব মুসলিম তথা
সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য আছে। কেন না, ওগো
আমার প্রভু। আমাদের স্মরণ ও জীবনসাধন যে এক তোমারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত । হে জগৎ
প্রভু! হে আল্লাহ্! আঠারো ফাল্গুনের এ আত্মত্যাগ তুমি কবুল করলে কি না, তা জানিয়ে দাও, জানিয়ে দাও
দয়াল
আল্লাজী । আমার
দয়াল
আল্লাজী ।
তোমার
নামে জান দিলাম যে
কবুল
করলানি? মওলা কবুল
করলানি?
২রা
ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ সালে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত ।
সরদার
আলাউদ্দিন এখন কোথায় আছেন জানি না। তিনি কি
মৃত
না জীবিত তাও জানি না। তার সম্পর্কে যদি কেউ কোন তথ্য দিতে পারেন, তাহলে পরবর্তী সংস্করণে তা কৃতজ্ঞতার সাথে সংযোজিত হবে। এ ব্যাপারে বিশেষ করে
কবি আফজাল চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
Comments
Post a Comment