পর্ব চার: ডক্টর আহমদ শরীফ
ডক্টর আহমদ শরীফ
(জন্ম ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯২১-মৃত্যু ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)
ডঃ
আহমদ শরীফ । ডাক নাম লেধু । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন গবেষক, কলামিস্ট, সভাপতি-স্বদেশ চিন্তা সংঘ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জন্ম
নেয়া ঘাদানিকের তথাকথিত গণআদালতের ২৪ জন গণআদালতীর অন্যতম সদস্য। জন্ম : ১৩ই
ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সাল। জন্মস্থান : চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সুচক্রদন্ডী গ্রাম।
পিতা আব্দুল আজিজ, মা সিরাজ খাতুন। পিতা ছিলেন
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের করণিক । ডঃ আহমদ শরীফ প্রথমে চট্টগ্রামের আলকরণে একটি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে পটিয়া ইংরেজি উচ্চ
বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন ও ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা
পাস করেন। তারপর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট কলেজে ভর্তি হন এবং ৪ বছর পর বিএ পাস করেন ।
১৯৪২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে ভর্তি হন ও ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে
চতুর্থ হয়ে এমএ পাস করেন। এরপর ১৯৪৫-৪৮ পর্যন্ত লাকসামের পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা
ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ই নভেম্বর ফেনীর সালেহা
মাহমুদের সঙ্গে বিবাহ হয় । ১৯৫৩-এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহায়ক হিসাবে
নিয়োগ পান । মাঝে মাঝে ২/৪টি ক্লাস নিতেন। ১৯৬৭-এর এপ্রিলে ১৬শ' শতকের প্রখ্যাত কবি সৈয়দ সুলতান, তাঁর
যুগ ও তাঁর রচনাবলী বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলা একাডেমী থেকে মধ্যযুগের
অবহেলিত কবি ও মুসলিম সাহিত্যিকদের পুঁথি সম্পাদনা ও প্রকাশনায় নিয়োজিত ছিলেন।
স্বরচিত তার গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৪০টি। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর
গ্রহণ করেন। ডঃ আহমদ শরীফের অনার্স ডিগ্রি ছিল না। বিএ-এর পর এমএ পাস, তাও দ্বিতীয় বিভাগ। কয়েক বছর বেকার থাকার পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে পরীক্ষামূলকভাবে
বাংলা বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। কিন্তু কোন কৃতিত্ব দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি
অপসারিত হন। পরবর্তীতে তাঁর চাচা আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রচেষ্টায়
তৎকালীন পাকিস্তানের বেতারমন্ত্রী জনাব নাজমুর রহমানের অনুরোধে রেডিও পাকিস্তানে
অস্থায়ীভাবে প্রোগ্রাম এসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিয়োগ পান। এখানেও তিনি বেশি দিন
টিকতে পারেননি। পুনরায় তাঁর চাচা আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদই আহমদ শরীফকে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেয়ার শর্তে তাঁর সংগৃহীত বিশাল পুঁথির ভান্ডার
বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন । এ দানকৃত পান্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য রিসার্চ
এসিস্ট্যান্ট হিসাবে নিয়োগ পান আহমদ শরীফ। এসব পান্ডুলিপি সম্পাদনা করে তিনি
বাংলা বিভাগের লেকচারার হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন ।
ডঃ
আহমদ শরীফ পাকিস্তান আমলে ছিলেন মুসলমানদের একজন স্বজন । এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫শে
মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা ছিল কট্টর পাকিস্তানবাদী।
১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি 'যখন যেমন তখন তেমন' ভূমিকা পালন করেন। অতীতকে ভুলে যান। অতীতকে ভুলে গেলেও অতীতের কোন কোন ঘটনা
স্মৃতিচারণে এসে পড়তো। ডঃ হুমায়ুন আজাদ ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডঃ আহমদ
শরীফের যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, সে সাক্ষাৎকার ১৫ই
ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ সালের সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রচ্ছদ কাহিনী হিসাবে প্রকাশিত হয়।
সেই সাক্ষাৎকারে ডঃ আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “চট্টগ্রাম
কলেজে যখন পড়ি, তখন মুসলমান ছাত্রদের আমি একজন নেতা
ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে বড় ভাই বললেন, 'আমাদের মত নিম্নবিত্তের মানুষের রাজনীতি করা সাজে না। বড় লোকেরই ওই সব সাজে।
বড় লোকের ছেলেরাই নেতা হয়।' একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন, ‘মতিলালদের ছেলে জওহর লালেরা কিছু না করেও নেতা হন। অন্যরা হ্যান্ডবিল বিলি করে, চেয়ার টানে । কাজেই তুমি আর পলিটিক্স করো না।' এটা
বলার একটা কারণ ছিল । আমাদের বিএ পরীক্ষার আগে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের
বোমা পড়ে আর আমরাও বায়না ধরি যে, টেস্ট
পরীক্ষা দেব না। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা নেবেই। ফজলুল হক সাহেব তাঁর
কয়েকজন মন্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন নোয়াখালী আমরা সেখানে গেলাম। তিনটি হিন্দু ছেলে ও
আমি। আমি ছিলাম নেতা। অবশেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে আপোস করেন, আমরা শুধু এক পেপার পরীক্ষা দেব ।
আমি
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, তখন কোন নির্বাচনে অংশ নিলাম
না, কিন্তু অভ্যাস দোষে কর্তা ব্যক্তিদের মাঝে একজন
ছিলাম।”
লক্ষণীয়
দিকটি হচ্ছে এই, তাঁর এই জবাবের মধ্যে অবচেতনভাবে
দুবার মুসলমানিত্বের কথা এসেছে। একবার এসেছে চট্টগ্রাম কলেজের মুসলমান ছাত্র নেতা
হিসাবে। অন্যবার এসেছে শেরেবাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় হিন্দু তিনজন ছাত্র
থেকে নিজেকে পৃথক পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে ।
তিনি
গর্ব করে বলতেন, 'আমি নাস্তিক।' কিন্তু তিনি আস্তিক মুসলমান কবি সৈয়দ সুলতানের ওপর গবেষণা করেছেন। তাঁর রচনার
ওপর থিসিস লিখে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন। বাংলা একাডেমী থেকে মধ্যযুগের অবহেলিত
কবি ও মুসলিম সাহিত্যিকদের পুঁথি সম্পাদনা করেছেন, প্রকাশনায়
সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। এসব তো স্বজনেরই লক্ষণ ।
ডঃ
আহমদ শরীফের রচনার কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এমনকি
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে একজন নাস্তিক বলে পরিচয় দিতে উৎসাহী ছিলেন এবং যাবতীয়
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের বিরোধিতায় ছিলেন সোচ্চার। ইসলামের অনুসারী
মুসলমানদের নিন্দা জ্ঞাপনে ও তাদের হীন বর্ণে চিত্রিত করতে 'সাহসী' ভূমিকা পালন করলেও পাক আমলে তার
ভূমিকা ছিল অন্যরূপ। তার সে সময়ের লেখার উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘ইসলামে বিশ্বাসের (ঈমানের) সঙ্গে সৎ-কর্ম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত । যা তোমার
নিজের জন্য কাম্য নয়, তা তোমার ভাইয়ের জন্যও কামনা
করো না। বেঁচে থাক, বাঁচতে দাও, ভাল চাও, ভাল কর। এই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা ।
কোরআনের সর্বত্র পার্থিব জীবনে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পারস্পরিক ঘরোয়া ও
সামাজিক ব্যবহারের বিধি-নিষেধই নির্দেশিত হয়েছে। অতএব ইসলাম মুখ্যত ব্যক্তিক ও
সামাজিক জীবন-বিধি (Code of Life), জেহাদও
এ বিধির অন্যতম অঙ্গ। পার্থিবতাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য ধর্মের তুলনায়
এর শ্রেষ্ঠত্বও এখানেই।' [দ্রঃ জেহাদের স্বরূপ, আহমদ শরীফ, সওগাত, শ্রাবণ, ১৩৬৮] অন্যত্র ডঃ আহমদ শরীফের বক্তব্য : মানুষের মনুষ্যত্ব স্বীকৃতি পেল, আল্লাহ মানুষকে শক্তিও দিয়েছেন। ধর্ম শুধু কলের প্রত্যঙ্গ নয়, মানুষ এক একটি সত্ত্বা, আল্লাহর প্রতিনিধি মানুষ। 'নিয়তি' নেই, শুধু
'নিয়ম' আছে।
তার কারণ, নিরপেক্ষ কার্য অসম্ভব। আল্লাহ শুধু
দুনিয়ার অন্য যাবতীয় বস্তুর মালিক নন, মানুষেরও
মালিক। গোটা দুনিয়া সৃষ্টিরই (জড়জীব), বিহার-বিলাস-ভোগ
ক্ষেত্ৰ
শুধু
মানুষের একার নয় এবং জড়-জীব পরস্পর নির্ভরশীল। অতএব আদর্শ হোক Live
and let live (বেঁচে থাকো এবং বাঁচতে দাও)। ধর্ম হোক
বিবেক-নির্দেশ ও যুক্তিবোধ গ্রাহ্য । আজকের মানুষের প্রাণের কথাই এই । [দ্রঃ
বিশ্বের নাগরিক, আহমদ শরীফ, সওগাত, আশ্বিন, ১৩৬৮ । 'আমাদের বাংলা ভাষায় স্বকীয় আদর্শ
সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আদর্শ হবে কোরআনের শিক্ষা ।
আর তা হবে মুসলমান ঐতিহ্যানুগ আর বিষয়বস্তু হবে ব্যক্তি বা সমাজ অথবা বৃহদার্থে
জগৎ জীবন। এভাবে আমাদের সাহিত্য ও জাতীয় জীবন গড়ে উঠবে (মাসিক মোহাম্মদী : পৌষ
১৩৫৮ বাংলা, ডঃ আহমদ শরীফ, তাঁর 'বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ধারায় হিন্দু
প্রভাব' নিবন্ধ দ্রষ্টব্য] ।
‘পুঁথির ফসল' নামক বইয়ের ভূমিকায় ডঃ আহমদ শরীফ
লিখেছিলেন, ‘আঠারো-উনিশ শতকী দোভাষী সাহিত্য
আমাদের নগর-বন্দর এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন-মানসের তথা জীবন চর্চার প্রতিচ্ছবি ও
প্রতিভূ। এই সাহিত্যই উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ অবধি শতকরা নব্বইজন বাঙালি
মুসলমানের মনে জাগিয়ে রেখেছে ইসলামী জীবন-ঐতিহ্য-চেতনা । সাহিত্য রচনার শেষ শব্দ
যদি সমাজকল্যাণ হয়, তাহলে মানতেই হবে- দোভাষী সাহিত্য গত
একশ' বছর ধরে অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত মুসলমানের জগত
ও জীবন-ভাবনার নিয়ামক (পুঁথির ফসল : আহমদ শরীফ, পাকিস্তান
পাবলিকেশন্স, ১৯৬৬ ইং, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৫ ৷
পাকিস্তানী
আমলে ডঃ আহমদ শরীফ তাঁর বহু নিবন্ধে ইসলামের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে
ধরেছেন, আল্লাহর মহিমারও গুণগান করেছেন। ‘ধর্মীয় গোঁড়ামি' ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা
বললেও সে সময়ে তিনি কখনও ধর্মকে সরাসরি অস্বীকার করেননি এবং একালের মত নিজেকে
আস্তিক্য বিরোধী বলেও আখ্যায়িত করেননি বরং জাতীয়তা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে
ধর্মীয় আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ এবং বিশেষভাবে
ইসলামের প্রভাব গভীর, সে কথাও তিনি তাঁর অনেক
নিবন্ধে বলেছেন। বস্তুত, ডঃ আহমদ শরীফ ও তাঁর
সগোত্রীয় বুদ্ধিজীবী অনেকের চিন্তাধারাও মূল্যবোধের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটেছে
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর, ১৯৭২ সালে 'সিক্যুলারিজম' ও 'বাঙালি
জাতীয়তা'কে সংবিধানের চার মূলনীতির
অন্তর্ভুক্ত করার প্রেক্ষাপটে । অভিযোগ রয়েছে, মৌলভী
ফরিদ আহমদকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লালবাগের এক বাসা থেকে তিনিই ধরিয়ে দেন। অথচ
এই ফরিদ আহমদই তাকে সংগ্রামের ৯ মাস আগলিয়ে রেখেছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বরের পর তিনি
অন্য মানুষ হয়ে গেলেন ।
পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং ইসলামের আদর্শকে সামনে রেখে।
তাই সে সময়ের প্রেক্ষাপটে দ্বিজাতিতত্ত্বের ও ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্য এবং ইসলামী
সংস্কৃতির মহিমা গুণগানে অনেকে আত্মনিয়োগ করেন। এমন কিছু বুদ্ধিজীবীকে দেখা যায়, যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ‘সেক্যুলারিজম' ও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী'-এর জয়গানে মুখর হয়ে উঠেন এমন কি কেউ কেউ এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব' আর ধর্মীয় আদর্শ ও ঐতিহ্যের
মুন্ডুপাত করেন। পাকিস্তানি আমলে 'মুসলিম
বাংলা সাহিত্য মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম
বাংলার সাময়িকপত্র' ইত্যাদি গ্রন্থ ও এ জাতীয় অনেক
প্রবন্ধ লিখে যারা বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র মুসলিম সাধনার ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, তাদের অনেকেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে কলম ধরেন
এবং বাঙালি জাতীয়তা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রবক্তা হয়ে ওঠেন I এমনকি 'মুসলিম সাহিত্য' 'মুসলিম সংস্কৃতি' ইত্যাদিকে 'সাম্প্রদায়িক' ব্যাপার বলতেও পিছপা হননি ।
এস,এ, বিজয় তিলক-এর নিবন্ধ 'কায়েদে আযম প্রেরণাদায়ক আদর্শ’ শিরোনামে
ডঃ আহমদ শরীফ অনুবাদ করেন এবং তা পত্রিকায় প্রকাশ করেন। জিন্নাহ চরিত্রে তিনি
প্রভাবিত না হলে নিশ্চয়ই নিবন্ধটি অনুবাদ করতেন না। নিঃসন্দেহে তাঁর সে সময়ের
ভূমিকা ছিল স্বজনের ভূমিকা।
ডঃ
হুমায়ুন আজাদের দৃষ্টিতে আহমদ শরীফ : ডঃ আহমদ শরীফের ছাত্র ডঃ হুমায়ুন আজাদ ।
শুধু ছাত্রই নন, সহকর্মীও ছিলেন। ডঃ হুমায়ুন আজাদ
তাঁর শিক্ষক ও সহকর্মী ডঃ আহমদ শরীফ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা পাঠকদের জন্য পেশ করছি। তিনি বলেন, ডক্টর
আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির
এই ছোট্ট বদ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তাঁর। প্রতিবাদী তিনি, দেবতারা
যেখানে ভয় পায়, তিনি সেখানে উদ্ধত শিরে উপস্থিত হন।
তিনি বিদ্রোহী। সব রকম প্রথা সংস্কারের শৃঙ্খল ধরে খুব জোরে তিনি টান দিচ্ছেন
কয়েক দশক ধরে। তাঁর মুক্তবুদ্ধি ও প্রথা বিরোধিতা আকৃষ্ট করেছে প্রগতিশীলদের।
তাঁর কাছে দেশের সবচেয়ে পবিত্র স্থান শহীদ মিনার। সমাজতন্ত্রকে তিনি তাঁর আদর্শ
হিসাবে গণ্য করেন। প্রচণ্ড ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী তিনি। কখনো তাঁকে মনে হয়
একজন অভিজাত সামন্ত, কখনো মনে হয় পশ্চিমা বুর্জোয়া।
কখনো মনে হয় শ্রেণীহীন বিপ্লবী, কখনো মনে হয় রোমান্টিক, আর কখনো মনে হয় নৈরাজ্যবাদী। তাই কোন বিশেষ সংঘের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যান
না তিনি বরং তাঁকে খাপ না খাওয়া মানুষ বলে মনে হয় অনেক সময়। (কিন্তু ঘাদানিকদের
সঙ্গে খাপে খাপ মিললেন কেমন করে এই প্রচণ্ড ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী লোকটি? এ প্রশ্ন আমার)।
প্রথা
সম্মত ভদ্র লোকেরা অসৎ ও ভণ্ড। ডক্টর আহমদ শরীফ প্রথা সম্মত ভদ্রলোক নন । তিনি
উচ্চ কণ্ঠে তর্ক করেন, উত্তেজিত হন, সরবে অসৎ ব্যক্তির নিন্দা করেন। রূঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেন অন্যায়ের। প্রথাসম্মত
ভদ্রতাকে ঘৃণা করে তিনি রোধ করতে চান সুবিধাবাদী ভদ্রতাকে। ‘বেআদবি' নামে প্ৰবন্ধ লিখে স্তব্ধ করেন তিনি
বিদ্রোহী বেআদবদের। কিংবদন্তীর বিপরীত ব্যাপারকে বলতে পারি ‘ব্যক্তিত্ব’, আর তা ব্যাপকভাবেই ধারণা করেন ডক্টর
আহমদ শরীফ। (এটা তিনি কিভাবে ধারণ করেন, এ
সম্পর্কে ডঃ হুমায়ুন আজাদ থেকে শুনুন) তিনি (ডঃ আহমদ শরীফ) উত্তেজিত হলে সারা ঘরে
ঝড় বয়, ক্রুব্ধ হলে চারদিকে বহু কিছু ভেঙ্গে
পড়ার শব্দ শোনা যায় ।
তিনি
আধুনিক উজ্জ্বল পোশাক পরেন, ঝকঝকে জীবন-যাপন করেন। আধুনিক
চিন্তা-ভাবনা করেন। তাঁর বাসায় যেয়ে আরো বিস্মিত হয়েছিলাম । সেই অল্প বয়সে
ধারণা হয়েছিল, ডক্টর আহমদ শরীফ যেহেতু
সমাজতান্ত্রিক, তাই তাঁর বাসা হবে দারিদ্র্যের
কামড়ে ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু ঢুকেই দেখি বিশাল ড্রইং রুম, উজ্জ্বল কার্পেট, দামি আসন, তৈজসপত্র। তাঁর নিজের আসনটি সুনির্দিষ্ট, যাতে
একটি কলিং বেলের সুইচ পর্যন্ত লাগানো। বেল টিপলেই কোন না কোন পুরাতন ভৃত্য সাড়া দেয়।
(সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫, প্রচ্ছদ কাহিনী-পণ্ডিত ও বয়স্ক
বিদ্রোহী ডক্টর আহমদ শরীফ-বাঙালি সংস্কৃতির কোন চিরস্থায়ী রূপ নেই) ।
পাকা
নাস্তিকের পাকা স্পষ্ট কথা
[রচনা-২রা মার্চ ১৯৮৫ ইংরেজি সাল]
মনে
আর মুখে এক- এমন যে জন, তিনি আমার শত্রু হলেও তাঁকে
শ্রদ্ধা করি। ডঃ আহমদ শরীফ সেই জাতের মানুষ। যার মন ও মুখ এক। তাঁর চিন্তাধারা আর
জীবনধারার সঙ্গে আমার চিন্তাধারা ও জীবধারার আসমান-জমিন ফারাক। থাকা সত্ত্বেও আমি
তাঁকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে মোবারকবাদ জানাই তাঁর স্পষ্টবাদিতার জন্য। সাপ্তাহিক
বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনীতে ডঃ হুমায়ুন আজাদের উপস্থাপনায় ডঃ আহমদ শরীফকে মননে ও
বচনে এবং নিখুঁত চরিত্র চিত্রায়নে নেকাব ছাড়া চেহারায় যেভাবে দেখলাম, এভাবে আমি আমার জীবনে খুব কম লোককে দেখেছি। আমি ডঃ আহমদ শরীফকে স্বরূপে দেখে
অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। মুখোশ ছাড়া মুখ দেখলে কার না ভাল লাগে। মুখোশওয়ালা
মানুষ ধান্ধাবাজ ।
আসল
মুখ দেখলে প্রতারিত হবার ভয় থাকে না । শত্রুকেও ভাল লাগে, যদি তার মন ও মুখ সব সময় এক দেখা যায়। ডঃ আহমদ শরীফকে অরিজিন চেহারা-চরিত্রে
আবির্ভূত হতে দেখে এ জন্যই মনের আনন্দে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। অবশ্য তাঁর পৈত্রিক
নামের সঙ্গে ব্যক্তিগত চিন্তাধারার অমিল দেখে খুশি হইনি। এফিডেবিট করে নাম
পরিবর্তন করলে আর কোন সন্দেহ থাকতো
না
।
মর্দের
মর্দামী শুধু গায়ে-গতরেই নয় বরং স্পষ্টবাদিতা ও সাহসিকতায়ও । ডঃ আহমদ শরীফ তাঁর
জীবন-দর্শন তথা বিশ্বাস নিয়ে লুকোচুরি খেলা খেলেননি। যা সত্য ও সঠিক মনে করেন, তা তিনি সাফ সাফ বলে দেন। তাঁর কথা কারো ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, সে পরোয়া তিনি করেননি। তাঁর ঈমানে' তিনি
'কামেল' ।
ডঃ
হুমায়ুন আজাদের উপস্থাপনায় ডঃ আহমদ শরীফের চরিত্রকে যেভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে
তাতে দেখা যায় যে, (ডঃ হুমায়ুন আজাদের ভাষায়) 'ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য, দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তাঁর।' আমিও বলি, তিনি 'পলিমাটির
এ ছোট্ট বদ্বীপে' অনন্য বলেই মনে হয়। তবে অনেকে আছেন, তাদের মুখে মুখোশ রয়েছে বলে চেনা যাচ্ছে না। ডঃ আহমদ শরীফের মত সাহস সঞ্চয়
করে কোন দিন যদি তারা মেহেরবানি করে মুখোশ খুলে ফেলেন, তাহলে আজ যিনি 'অনন্য', তিনি হবেন ‘অন্যতম'। তবে এ পর্যন্ত ডঃ আহমদ শরীফ ‘অনন্যই’ আছেন। মুখোশ পরা প্রগতিশীলরা মুখোশ খুলতে পারলে সাধারণ মানুষ বড়ই উপকৃত হতো।
তারা আসল-নকলকে সহজেই পরখ করতে পারতো। তিনি (ডঃ আহমদ শরীফ) বিদ্রোহী, সব রকম প্রথা সংস্কার-শৃঙ্খল ধরে খুব জোরে নাকি কয়েক দশক ধরে ভীষণভাবে
টানাটানি করছেন। কিন্তু এখনও এই টানাটানিতে কাউকে সহযোগিতায় পাননি। এ জন্য তিনি
নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। করারই কথা। কাহাতক একা একা টানাটানি করা
যায়। তাই মনে দারুণ হতাশা। এই হতাশা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য বিভিন্ন 'বাদ'-এর সংমিশ্রণ নিজের মধ্যে ঘটিয়ে আরো
বেশি হতাশায় ভেঙে পড়ে অধিকতর বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। ডঃ হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ভাববাদ-মানবতাবাদ-মার্কসবাদের এক বিক্ষুব্ধ সংমিশ্রণ ডঃ আহমদ শরীফ।' বিক্ষুব্ধ সংমিশ্রণ যে ঘটেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ
সম্পর্কে তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীর মন্তব্য হলো এই, প্রথাসম্মত
ভদ্রতাকে তিনি ঘৃণা করেন। ‘বেয়াদবি’ নামে প্রবন্ধ লিখে স্তব্ধ করেন বিদ্রোহী বেয়াদবের। উত্তেজিত হলে সারা ঘরে ঝড়
বয়। ক্রুব্ধ হলে চারদিকে বহু কিছু ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা যায় ( চায়ের কাপ, পিরিচ, বাসন ইত্যাদি)। বিক্ষুব্ধ মিশ্রণের
প্রকাশ এভাবে ঘটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিভিন্ন জাতের কেমিক্যাল এক পাত্রে রেখে
নিরন্তর নাড়াচাড়া করলে রি-অ্যাকশন হবেই। বাংলা ভাষায় যাকে বলে প্রতিক্রিয়া। এই
প্রতিক্রিয়ার ধর্ম মেনে যারা চলেন, তারাই
হন প্রতিক্রিয়াশীল বা রি-অ্যাকশনারী অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ সংমিশ্রণ। একরূপে অপূর্ব
দেখায়, বহুরূপে হতে হয় বহুরূপী। বহুরূপী
মানেই অশান্তি আর সে যে কি মারাত্মক অশান্তি, তা
শ্রীকান্ত উপন্যাসের বহুরূপীই মর্মে মর্মে টের পেয়েছে।
ডঃ
আহমদ শরীফ এমন কি সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন, যা
পাঠ করে আমি এত আনন্দিত হয়েছি? তিনি বলেছেন, তিনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী । তিনি কমিউনিস্ট । তিনি কোন ধর্মে
বিশ্বাস করেন না। সকল ধর্মগ্রন্থকে তিনি মনে করেন 'ম্যানমেইড' (মানবরচিত)। তাঁর ভাষায়, ‘নাস্তিক্যধারা জীবন দর্শনে
আমি বিশ্বাসী । স্রষ্টা থাকতে পারেন, কিন্তু
শাস্ত্র থাকবে এমন কোন কথা নেই ৷ স্রষ্টা থাকলেই তার উপাসনার প্রয়োজন আছে, তা আমি বিশ্বাস করি না। বিবাহ-পূর্ব যৌন মিলনে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং এর
জন্য শিক্ষার দরকার আছে। চলচ্চিত্রে চুমু খাওয়া দোষের হতে পারে না। মদ্য পান তো
খারাপ জিনিস নয়। পরকালে আমি বিশ্বাস করি না।'
এমনভাবে
নিজের বিশ্বাসের কথা স্পষ্ট ভাষায় ক'জনই
বা বলতে পারেন? সমাজতন্ত্রী ঈমানে পাক্কা ঈমানদার
তিনি। যারা সমাজতন্ত্রী হবার অনুশীলন করছেন বা সমাজতন্ত্রী অথবা কমিউনিস্ট হয়ে
গেছেন বলে দাবি করেন, তাদের সমাজতন্ত্রী ঈমান
কতটুকু পাকাপোক্ত হয়েছে, তা ডাঃ আহমদ শরীফের নাস্তিক্য
ঈমানের আয়নায় দেখে নিতে পারেন। কিভাবে এবং কি বিশ্বাস নিয়ে কমিউনিস্ট হতে হয়, ডঃ আহমদ শরীফ তার এক দৃষ্টান্ত। কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক্য বিশ্বাসে বিশ্বাসী।
একজন কমিউনিস্ট যদি বলে আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি না, শাস্ত্রে বিশ্বাস করি না, ধর্মে ও আখেরাতেও আমার
বিশ্বাস নেই, তাহলে আমি বলবো, সে সঠিক কথা বলেছে। এ ক্ষেত্রে তার ঈমানে কোন ভেজাল নেই, মন ও মুখ তার এক। যে আল্লাহতে বিশ্বাস করে না, তার
ধর্ম, শাস্ত্র ও পরকাল মানার প্রশ্নই উঠে না ।
ডঃ
আহমদ শরীফ মুনাফিক কমিউনিস্ট নন । তিনি সমাজতন্ত্রে ইসলাম যোগ করে সাধারণ মানুষকে
ধোঁকা দেয়ার জন্য কখনো এ কথা বলেননি যে, সমাজতন্ত্রে
যারা বিশ্বাস করেন না, তারা ইসলামে বিশ্বাসী নন অথবা
বলেননি যে, 'ধর্ম-কর্ম আর সমাজতন্ত্র হোক জীবনের
মূল মন্ত্র ।' তিনি বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে এ কথা কখনো
বলেননি যে, 'আমি আল্লাহতায়ালাকে হাজির-নাজির
জেনে বলছি', অথবা এ কথা কখনো বলেননি যে, 'সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের বিরোধ নেই', 'সমাজতন্ত্র
কখনো মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করে না।' ডঃ
আহমদ শরীফ বরং সাফ সাফ জবানে বলেছেন, 'আমি
সমাজতন্ত্রের পক্ষপাতী । তাই প্রথম লেখা থেকে আজ পর্যন্ত আমি মানুষের পুরনো
বিশ্বাস, সংস্কার, নিয়ম, শাস্ত্র ও প্রচলিত আইন সব কিছুকেই
আঘাত করেছি, বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত করে চলছি।' চমৎকার! খাঁটি সমাজতন্ত্রীর কথাই বটে। এটা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস
করতেই হয়, সমাজতন্ত্রীরা তা করেও থাকেন, কিন্তু অনেকে মুনাফিকীর মুখোশ পরে করে থাকেন বলে ঘোষণা করতে ভয় পান। ডঃ আহমদ
শরীফ সে ভয় করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে হাজার হাজার ছাত্রকে এই
ইলিম-তালিম দিয়েছেন ।
বিয়ের
আগে যৌন মিলন আর চলচ্চিত্রে চুম্বনের ব্যাপারটি আমার মতে এখানে অত্যন্ত গৌণ। কারণ, কোনো নীতি যিনি মানেন না, জবাবদিহির কোনো চিন্তা-চেতনাও
যার নেই, 'বিক্ষুব্ধ সংমিশ্রণ' যার জীবন-দর্শন, তাঁর পক্ষে এ ধরনের মন্তব্য করা আর
এমন রেওয়াজ-রীতির ওকালতি করা অত্যন্ত সহজ ও সম্ভব। সুতরাং এসব তাঁর বিশ্বাস ও
চরিত্রের ব্যাপার-স্যাপার। এ নিয়ে উচিত-অনুচিতের আলোচনা করা এখানে অবান্তর বলে
মনে করি।
ডঃ
আহমদ শরীফের মন আর মুখের এই ঐক্য আর তাঁর সাহসী প্রকাশ থেকে সকল ধরনের খলল ঈমানের
নির্জীব বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। সমাজতন্ত্রীরা তাকে মডেল হিসাবে
গ্রহণ করে মুখোশমুক্ত অবস্থায় প্রকাশিত হয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে
বাঁচাতে পারেন। কিভাবে কমিউনিস্ট হতে হয়, কিভাবে
মন আর মুখ এক করে কথা বলতে হয়, সে শিক্ষা তারা ডঃ আহমদ শরীফ
থেকে গ্রহণ করতে পারেন। অবশ্য মুখোশ পরে ধোঁকাবাজি করে আপন হওয়ার খল চিন্তা নিয়ে
যারা সমাজতন্ত্রী হয়েছেন, তাদের কথা ভিন্ন ।
ডঃ
শরীফের বিপরীত চিন্তাধারাকে যারা সঠিক মনে করেন, তাদেরও
উচিত নিজ চিন্তা ও বিশ্বাস প্রকাশের ব্যাপারে কমপক্ষে এ ধরনের দৃঢ়তা থাকা । নিজ
নিজ চিন্তা-বিশ্বাসকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ করতে যারা ভয় পান আর মুনাফেকী নেকাব
পরে সব দিকে তাল রাখেন, তারা প্রকৃতপক্ষেই কাপুরুষ।
মনের দিক থেকেও ক্লীব অর্থাৎ না ঘরকা, না
ঘাটকা । ডঃ আহমদ শরীফের চিন্তাধারায় যারা বিশ্বাসী, তারা
মেহেরবানি করে একে একে ঘোষণা দিয়ে যদি মুসলমানের প্লাটফরমটা খালি করেন, তাহলে আদমশুমারী কর্মীদের জাত-বিচারে কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না, আর আস্তিক-নাস্তিক চিনতেও সাধারণ মানুষের ভুল হবে না এবং মৃত্যুর পর জানাযার
প্রশ্নও কেউ তুলবে না
তিনি
মানুষ থাকতে পারলেন না রচনাকাল : ৮ই মে, ১৯৯২
সাল ]
ধর্মের
উপর ডঃ আহমদ শরীফের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য নিয়েই আমার এ আলোচনা। তাঁর মন্তব্যটি
হচ্ছে এই : 'ধর্মের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যে মানুষ
হয়, সে মানুষ থাকে না। তার মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ
ঘটে না। মানুষ হতে হলে বুদ্ধিজীবী হতে হবে'-ইত্তেফাক
২৪/৪/৯২। তিনি এই মন্তব্য করেন ২৩শে এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতায় ।
ধর্মের
আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে যে মানুষ হয়, সে প্রকৃতপক্ষে মানুষ না
অমানুষ হয় এবং তিনি ধর্ম না মেনে মানুষ না অমানুষ হয়েছেন, সে আলোচনা করা দরকার। তবে এ আলোচনায় যাবার আগে এই স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী সমীপে
আমি সবিনয়ে কয়েকটি প্রশ্ন রাখছি।
প্রথম
প্রশ্নটি হচ্ছে এই, আপনি সাম্প্রদায়িক কোন দলকে পছন্দ
করে না, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপনার
কণ্ঠ সদা সোচ্চার আর আপনার কলম শাণিত এক তলোয়ার। হিন্দু-বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান-এই তিন
সম্প্রদায়ের তিনটি নামকে কি আপনি সাম্প্রদায়িক নাম মনে করেন? যেমন 'ইসলাম' শব্দটি
শুনলে আপনি মনে করেন একটি সাম্প্রদায়িক শব্দ? যদি
তা মনে করে থাকেন, তাহলে আপনি কেন এই সাম্প্রদায়িক
ধর্মসভায় গেলেন? আপনি তো ধর্মই মানেন না, সেটা যে ধর্মই হোক। কারণ, আপনার বক্তব্য হচ্ছে এই, ধর্মের সংস্পর্শে থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মনুষ্যত্ব
থাকে না। আপনার মত একজন পাক্কা নাস্তিক এবং ধর্মবিরোধী ‘বুদ্ধিজীবী’ সেই ধর্ম সভার সংস্পর্শে গেলেন এবং
বক্তৃতাও করতে পারলেন, এটা কিভাবে সম্ভব হলো তা
বুঝলাম না। আপনি এই ধর্মসভায় যোগদান করে এবং ‘ওয়াজ’ করে কি ‘মানুষ' থাকতে
পারছেন? মনুষ্যত্ব রক্ষা করতে কি সক্ষম
হয়েছেন? ধর্মের বিরুদ্ধে আপনার এত কড়া
মন্তব্য শোনার পরও এই তিন ধর্মের উপস্থিত প্রতিনিধিরা আপনার ওপর নাখোশ হওয়ার ভাব
প্রকাশ না করার কারণ কি? আপনি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মকে কি ধর্ম মনে করেন না? ধর্ম
বলতে কি শুধু ইসলামকেই বুঝেন? হ্যাঁ, আমি জানি, আপনি ইসলামকে এখন দু'চোখে দেখতে পারেন না। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে সহ-অবস্থান নীতি কি মেনে
চলেন? আপনি ধর্মত্যাগী 'মানুষ' হয়ে, 'মনুষ্যত্ব' অর্জন করে এবং অধর্মের 'বুদ্ধিজীবী' হয়ে কট্টর সাম্প্রদায়িক সম্মেলনে কিভাবে গেলেন? সে ধর্ম সভায় যোগদান করে 'মানুষ' থাকতে পারেননি, ‘মনুষ্যত্ব’ও হারিয়েছেন, এই সাথে আপনার সাত রাজার ধন তুল্য 'বুদ্ধিজীবী' দাবিটাও হারালেন। এই সমাবেশে গিয়ে
যখন দেখলেন মঞ্চের পিছনের পর্দায় মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা, আর মসজিদের ছবি, তখন অধর্মের গহব্বর থেকে আহরিত আপনার ‘মনুষ্যত্ব' কি একটুও রি-অ্যাক্টও করলো না? সভাস্থলে
১ম ও ২য় সারিতে টিকি ও তিলকধারী উদামদেহী ঠাকুর, জটাধারী
সন্ন্যাসী, দীর্ঘ শ্মশ্রু ও গোঁফধারী সাধু, পাগড়ী ও জপমালা পরিধানকারী বাউল, গেরুয়া
পোশাকের ভিক্ষু ও শেষ সারির গোলটুপি লম্বা কোর্তা পরিহিত মৌলভী উপবিষ্ট দেখে আপনার
বিরোধী ধর্মনীতিবোধ কি একবারও আপনাকে ধাক্কা মারেনি? আমার
তো মনে হয়, আপনার 'মানুষ' পরিচিতি সে দিন শেষ হয়ে গেছে। সে
দিন আপনি মঞ্চের ওপর সাজানো চারটি ধর্মের কোটি গ্রহণ করে মানুষ থেকে অমানুষ হলেন, অধমকে অবহিত করলে অত্যন্ত কৃতার্থ হই ।
বাদ
আরজ এই, ধর্মের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে এ জগতে কে
কে অমানুষ থেকে মানুষ হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সেই সব মনীষীর কথা আপনাকে
শুনিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ, আপনি তাদের মানুষই বলেন না।
আপনি তো চরিত্রহীন কার্লমার্কস ও এঙ্গেলস, নিষ্ঠুর
ডিক্টেটর লেনিন আর কোটি কোটি মানুষ হত্যাকারী স্টালিন ছাড়া কাউকে মানুষ বলে গণ্যই
করেন না। তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন যার গর্ভে এবং ঔরসে, যারা আপনার মা-বাবা এবং আরো একজন আছেন, যার
যত্নে, লালনে আপনি বড় হয়েছেন, লেখাপড়া শিখেছেন, যার ঠেলা ধাক্কায় ম্যাট্রিক
পাস করে বাকি লেখাপড়া করেছেন এবং যার সুপারিশে উপযুক্ততা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে
চাকরি পেয়েছেন, এই তিনজন যথা আপনার মা, বাবা ও চাচাকে (আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ) কি আপনি মানুষ বলেন? তারা তিনজনই ছিলেন পাক্কা ধাৰ্মিক, নামাজী, রোজাদার এবং গভীর ধর্মানুরাগী। পিতা আব্দুল আজিজ শত ব্যস্ততায়ও নামাজ কাযা
করতেন না। শুনেছি, আপনি নাকি কোনো দিনই আপনার মা-বাবাকে
মা-বাবা বা আম্মা-আব্বা কোনটাই বলতেন না। সেটা কি তাদের ধর্মানুরাগের কারণে? 'মানুষ' হিসেবে স্বীকার করলেই তো প্রশ্ন আসে
সম্বোধন আর সম্পর্কের। এমনও শোনা গেছে যে, আপনি
ধর্ম ত্যাগ করে 'মানুষ' হয়ে
যাওয়ার কারণে মরহুম সাহিত্য বিশারদ নিজের মেয়েকে আপনার কাছে বিয়ে দেননি, যদিও তিনি আপনাকে চাকরি দিয়েছিলেন এবং আপনার ডক্টরেট পাওয়ার পিছনেও তাঁর
অবদান ছিল যথেষ্ট।
আমি
তো একজন ধর্মহীন অধর্মের মানুষকে জানি, যিনি
তার মা-বাবাকে কখনো কোনো দিন মা-বাবা বা আম্মা-আব্বা বলেননি। এ জন্য তার সন্তানেরা
তাঁকে বাবা বা আব্বা বলেনি বরং তাকে আজব এক শব্দ দিয়ে সম্বোধন করে থাকে আর সেই
শব্দটি হলো 'চুকুন বাছা।' বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তাঁর সাপে-নেউলে সম্পর্ক। মামলা-মোকদ্দমা চলে দীর্ঘ
দিন। একে অন্যের মধ্যে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না বড় ভাইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত। অন্য
এক ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তিক্ত সম্পর্ক । আপনি কি সেই ব্যক্তি?
মানুষকে
রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার না করার শিক্ষা দেয় ধর্ম । আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ভাব
রাখার তাগিদ দেয় ধর্ম, মা-বাবাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে
সম্বোধন করতে শিক্ষা দেয় ধর্ম। শুধু তাই নয়, যৌন
জীবকে নৈতিক জীবে পরিণত করে ধর্ম, জীবনে শৃঙ্খলা আনে ধর্ম।
ধর্মই প্রত্যেককে জীবন চলার পথে পাহারা দিয়ে জীবনের মূল লক্ষ্যে পৌঁছায়। এসব কথা
আপনি বুঝবেন না। কারণ, অধর্মের বা ধর্মহীনতার
রসায়ন-রস দিয়ে আপনার মগজ ধোলাই করে রাখা হয়েছে। ধর্মের ওয়াজও আমি আপনার কাছে
করতে চাই না ৷ কারণ, আপনি মুক্ত মন নিয়ে কোন ভাল কথা
শোনার মত ফর্মেও নেই। একটি কথাই শুধু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, যে ধার্মিক ব্যক্তিটির সুপারিশে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেলেন, সেই সুপারিশে তো ধার্মিকের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও দোয়া আছে। এই সুপারিশের সুফল
ভোগ করার কারণে কি আপনার 'মানুষ' পদবাচ্য আর ‘মনুষ্যত্ব' খোয়া যায়নি? হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক পরিষদ। সেই পরিষদের সম্মেলনে যোগদান দিয়ে আর বক্তৃতা করে
কি নিজ সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি 'মানুষ' থাকতে পারলেন?
খাসলতের
খুঁজলি-পাঁচড়া রচনাকাল : ২৮শে অক্টোবর ১৯৯২]
ডঃ
আহমদ শরীফের খাসলতের খুজলি-পাঁচড়া রোগ আর কলবের ব্যাধি মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে
ওঠে। ডঃ শরীফের মত আরও অনেকেই আছেন, তারাও
একই ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিন্তু তাদের ব্যাধির প্রকাশ কিছুটা মুনাফিকির আবরণে আবৃত
থাকে। আর ডঃ আহমদ শরীফের ব্যাধির প্রকাশ বিলকুল উদাম। কোন রকমের মুনাফিকী নেই। যা
বলেন, সাফ সাফ বলেন । তাঁর বলাবলিতে কোন রাখি-ঢাকি
ব্যাপার নেই। যখন তিনি নেংটা হন, তখন পুরোপুরিই নেংটা হতে
পারেন। জাঙ্গিয়াটাও খুলে ফেলেন। আমি ডঃ আহমদ শরীফকে বরাবরই মোবারকবাদ জানাই
সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান দিগম্বর চরিত্রের জন্য। মুনাফিকী নেই তার কথা ও কাজে। এ
জন্য তার পচন চরিত্রের উৎকট দুর্গন্ধ যে নির্ভেজাল দুর্গন্ধ, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই ।
বলছিলাম, মাঝে মাঝে তাঁর দেহ ও মনের ব্যাধি প্রচণ্ডভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । গত ২১শে
অক্টোবর বুধবার (১৯৯২) জাতীয় জাদুঘর শিশু মিলনায়তনে ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ' আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির
ভাষণ দেয়ার সময় ডঃ শরীফ পুরানো ব্যাধিতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন এবং এক
পর্যায়ে রীতিমত দিগম্বর হয়ে প্রলাপগুলো বকতে থাকেন। তার প্রলাপগুলো একে একে
বিন্যাস করে পেশ করছি।
* মুর্খতা ও মুসলমানিত্ব অভিন্নার্থক । যে লোক জ্ঞানী সে নাস্তিক ।
* পৃথিবীতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা আস্তিকেরা করেনি ।
* যে কোন আস্তিকের চেয়ে একজন নাস্তিক সব সময়ই ভাল ।
* প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ইসলাম টিকে আছে ইতর ও অজ্ঞানদের মধ্যে।
*(তিনি প্রশ্ন রেখেছেন) ক'জন শিক্ষিত লোক ধর্মে বিশ্বাস
করে?
* প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মের অস্তিত্বহীনতা। (হাছা কথা, কথার মত একখানা কথাই বটে)।
* দেশে এখন তিন ভাষায় পড়ালেখা হচ্ছে। ধর্মান্ধরা পড়ছে আরবীতে, বড় লোক বদমায়েশদের ছেলেমেয়ে পড়ছে ইংরেজিতে, আর
মধ্যবিত্ত ও গরিবরা পড়ছে বাংলায় ।
* পুরুষদের যদি ‘সততা' দরকার
না হয়, নারীদের সতীত্বের দরকার কেন? নারীদের এ প্রশ্ন করার সাহস থাকতে হবে ।
* দেশে এখন প্রতি দু'জন লোকের একজন চোর ।
ডঃ
আহমদ শরীফের এই সব প্রলাপ-প্রবচন বা তাঁর পচন-চরিত্র থেকে নির্গত দুর্গন্ধময়
বাক্য নিয়ে দফাওয়ারী আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই । তাঁর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগও
নেই। আইনের পুস্তকে নাকি আছে, পাগলের প্রলাপ বা পাগলের
পাগলামি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোন মামলা চলে না। আইন যদি তাই হয়, তাহলে আমি এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ডঃ শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগ
দায়ের করতে চাই না। পাগলের বিরুদ্ধে মামলা না চলার বোধহয় কারণ এ হতে পারে যে, মাথাটা খারাপ থাকার কারণে পাগলরা নৈতিক বিধি ও বাক্যের অর্থ এবং ভাব প্রকাশে
ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। তাই তাদের পাগলামিকে মামলার ঝামেলায় আনা হয় না।
কিন্তু তাই বলে বদ্ধ পাগলকে একেবারে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়াও হয় না, সুস্থ নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় যাতে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়, সে জন্য প্রশাসনের লোক এমন পাগলকে পাকড়াও করে পাগলা গারদে বা মানসিক
হাসপাতালে প্রেরণ করে থাকে ।
ডঃ
আহমদ শরীফের মত কোন বুদ্ধিজীবী পাগলকে এ পর্যন্ত আমাদের সরকার মন আর মগজ ধোলাই
করার লক্ষ্যে মানসিক হাসপাতালে বা পাগলখানায় প্রেরণ করেননি। এ জন্য এরা এত বেশি
পাগলামি করতে পারছেন। সাধারণ পাগলের চেয়ে এই পাগলরা অধিকতর খতরনাক ও ক্ষতিকারক।
সাধারণ পাগল উত্তেজিত হলে সামনে যা পায়, তা
আঘাত করে। কিন্তু এই পাগলরা তাদের পাগলামি বুদ্ধি ও বিকৃত চিন্তাকে পাণ্ডিত্যের
মুখোশ পরিয়ে সমাজে এমনভাবে পেশ করে, যা
দেখে ইবলিস শয়তানও ধূর্তামির প্রতিযোগিতায় হার মেনে নিয়ে এই মানব-শয়তানদের
বাহবা দেয়। এই মানব-শয়তানরা সমাজের মানুষকে ঈমান ও আখলাকের দিক থেকে সেভাবেই
নেংটা করতে চায়, যেভাবে তারা নেংটা হয়েছে ।
রসূল
(সাঃ)-এর একটি নাম আহমাদ। এই আহমাদ নাম ধারণ করে যে বলতে পারে ‘আমি নাস্তিক', তাঁর উচিত ছিল এসব কথা বলার আগে
এফিডেবিটের মাধ্যমে নাম পরিবর্তন করে নাস্তিক নাম নেয়া। এদিক দিয়ে বলা যায়, আহমদ শরীফ পাক্কা ধোঁকাবাজ অথবা কাপুরুষ। সাহস হয়নি নাম পরিবর্তনের। এই
মুনাফিকীর অভিযোগ ছাড়া ডঃ নাস্তিকের বিরুদ্ধে তাঁর দিগম্বরী চরিত্র সম্পর্কে অন্য
কোন অভিযোগ আমার নেই। কথায় বলে, 'ছাগলে কিনা খায় আর পাগলে কিনা
বলে।' আমাদের সমাজে বুদ্ধি-বিগুণজীবী পাঠা, খাসি আর বকরি এবং পাগল-পাগলিনীর উৎপাত-উপদ্রুব খুব বেশি শুরু হয়েছে। এদের
রাখাল বা মালিকদেরও পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের এই উৎপাত-উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার
জন্য জনগণই এদের গলায় রশি আর পায়ে জিঞ্জির লাগিয়ে খোঁয়াড়ে আটকাবার যদি অভিযান
শুরু করেন, তাহলে ঐ ছাগল-পাগলদের রাখাল ও
মালিকরা যেন কোন হৈ চৈ না করেন। সে অবস্থা শুরুর আগেই রাখাল আর মালিকরা তাদের
সামলান, এ আমার বিনীত আরজ ।
কথা
দিয়েছিলাম, ডঃ নাস্তিকের প্রলাপের দফাওয়ারী কোন
আলোচনা করবো না। কিন্তু তবুও দু'চার কথা না বললে যেন কেমন
কেমন লাগে ।
ইসলামী
জ্ঞানে জ্ঞানহীন মুর্খেরা মুসলমানিত্বকে মূর্খতার সমার্থক ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর। ইসলাম সম্পর্কে যার অল্প বিদ্যাও নেই, সে তো ইসলাম আর মুসলমানিত্বকে শুধু ভয়ঙ্করই ভাবে না, এরও অধিক কিছু ভাবে। ইবলিস নিজেকে অত্যন্ত জ্ঞানী মনে করেছিল। এ জন্য আল্লাহর
সিদ্ধান্তকে অমান্য করে। পরিণতি কি দাঁড়িয়েছিল তা ইবলিসের শিষ্য ডঃ নাস্তিক
হয়তো জানেন না। পৃথিবীর মোট আয়তনের ৬ ভাগের ১ ভাগ শাসন করতো ডঃ নাস্তিকের মত 'সৎ' আর ইবলিসের মত 'জ্ঞানীরা'। তাদের স্বর্গরাজ্যকে তারা অক্ষত কেন
রাখতে পারলো না? এমনকি ৭২ বছর পর্যন্ত 'জ্ঞানী নাস্তিকেরা এমন ‘সুখের দেশ'কে টিকিয়ে রাখতে পারলো না। জ্ঞানী নাস্তিকদের জনকদের গলায় ক্রেনের হুক
লাগিয়ে 'মারো ঠেলা হেঁইয়ো' করে ভূতলে ফেলে দিল কেন? ইসলাম তো ১৪ শতাধিক বছর থেকে
আছে। ক্রমশঃ তার বিস্তৃতি ঘটছে এবং মূর্খদের' দেশের
সংখ্যা ষাটের ধারে কাছে। ডঃ নাস্তিক সাহেব বলুন তো, ৭২
বছরে যা শেষ হয়ে গেল আর ১৪ শত বছর ধরে যার শুধু বৃদ্ধিই ঘটছে, কোটা মূর্খতার ফল, নাস্তিকের দুনিয়া, না ইসলামের দুনিয়া?
বলুন
আপনি
বলছেন, পৃথিবীতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা আস্তিকেরা করেনি।
আস্তিক হলেই কোন অপকর্ম করে না সে কথা আমিও বলি না। আস্তিক হয়েও অনেকে অপকর্ম
করে। কিন্তু নাস্তিকদের বাদ দিচ্ছেন কেন? নাস্তিকদের
বাপ বা খালু-মামু বলে যারা কথিত ও পরিচিত, তাদের
চরিত্র সম্পর্কে কি কোন খবর রাখেন? ভূত
হয়ে তারা আপনার পিঠে সওয়ার হয়েছে বলে কি তাদের দেখেন না? কার্লমার্কস আর এঙ্গেলসের মত চরিত্রহীনদের আপনি গুরু মেনেছেন, কিন্তু আপনি কি জানেন, বাসার চাকরানীর সাথে অপকর্ম
করে কিভাবে কার্লমার্কস নিজের স্ত্রীকে বিতাড়ন করেছিলেন? কি কারণে কার্লমার্কস বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়ে দিন কয়েক হাজতবাস
করেছিলেন? এঙ্গেলসের চরিত্র যে কি জঘন্য ছিল, তাও কি আপনার অজানা? নিষ্ঠুর ডিক্টেটর লেনিন আর
কোটি কোটি মানুষ নিধনকারী স্ট্যালিনের কর্মকাণ্ডকে কি আপনি অপকর্ম মনে করেন না?' এরা তো জ্ঞানী নাস্তিক, এ জন্য কি তাদের সব অপকর্মকে
সৎ কর্ম মনে করেন?
আস্তিকের
চেয়ে নাস্তিককে আপনি সব সময় ভাল মনে করেন। কারণ, আদর্শের
ভাইকে খারাপ বলতে যাবেন কেন? আপনি তো সেই আদর্শের । ওদের
খারাপ বললে আপনার মাসোহারা তো যাবেই, অস্তিত্বহীন
হয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। আপনি প্রশ্ন রেখেছেন, ক'জন শিক্ষিত লোক ধর্মে বিশ্বাস করে? ডঃ নাস্তিক সাহেব, আপনাকে কি আর বলবো, ধর্মে বিশ্বাস করে থাকেন এমন উচ্চ শিক্ষিত লোক এই পৃথিবীতে শুধু লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি আছেন। যাদের যে কোন একজনের কাছে আপনি বাকি জীবন যে কোন বিষয়ের ওপর
শিক্ষা গ্রহণ করলেও তাদের জ্ঞানের এক কণাও আয়ত্ব করতে পারবেন না। কুঠুরীর পেঁচা
স্বর্ণ ঈগলের (শাহীন) মর্ম ও কদর কি বুঝবে? আস্তিক
বাবার ঔরসে জন্ম নিয়ে হয়েছেন নাস্তিক। আপনার মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধেরও বড্ড অভাব।
যথাযথ যোগ্যতা ছাড়াও আপনি আস্তিক চাচার সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা
পেয়েছিলেন বলে 'ইবলিস জ্ঞানী' সেজেছেন । আপনার আস্তিক চাচাকেও কি আপনি মূর্খ বলেন? হ্যাঁ, বলতে পারেন এবং তা বলতেও পারবেন।
কারণ, যে শয়তান আপনার শিরায় শিরায় এমন কি রক্তের
কণায় কণায় মিশে গেছে, সে এসব কথা ছাড়া আর কোন ভাল
কথা কি শিক্ষা দিতে পারে?
নারীদের
সতীত্বের দরকার নেই বলে আপনার অভিমত। হ্যাঁ, এমন
অভিমত ব্যক্ত না করলে আপনি হয়তো আপনার চরিত্রের দাগগুলো মুছতে পারবেন না। আপনি
বলেছেন, এ দেশে প্রতি দু'জন লোকের একজন চোর। এই জরিপ আপনি কোন উপাত্ত ও উপাদানের ভিত্তিতে করলেন, তা জানি না । যদি আপনার এ জরিপ সঠিক হয়, তাহলে
আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আপনার সন্তানরা এবং আপনি ও
আপনার বেগম সাহেবা নিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ জন। বলুন তো, কোন তিনজন চোর? দু'জনে
একজন যদি চোর হয়, তাহলে আপনার পরিবারে ক'জন চোর হওয়া উচিত, আপনিই হিসাব কষে দেখুন এবং কে
কে চোর, তা চিহ্নিত হয়ে যাওয়া উচিত ।
আপনার
প্রতি আমার অনুরোধ, ভাল একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন
হন । আপনার চিকিৎসার দরকার। ব্রেন বিড়ম্বনায় ভুগছেন। চরিত্র তো আপনার গেছে বহু
আগেই। বুড়া বয়স। পাগল হয়ে মৃত্যুবরণ না করলেই আমি খুশি হবো। তবে চিকিৎসার দরকার
আরও অনেকের, যারা আপনাকে বুদ্ধি-বিকৃতজীবী জেনেও
বিভিন্ন মঞ্চে দাঁড় করায় ।
ডক্টর
নাস্তিক সাহেব, আপনি এত প্রলাপের মধ্যেও একটি সুস্থ, সুন্দর ও সত্য কথা বলেছেন। আর তা হচ্ছে এই- ‘প্রকৃতপক্ষে
ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মের অস্তিত্বহীনতা।'
ডঃ
শরীফের বিচ্ছিন্ন বিভ্রান্ত সংলাপ
‘আমি নাস্তিক্য ধারাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি । কূল-কিনারা না পেয়ে দুর্বলেরা
আস্তিক্যবাদ গড়ে তোলে, পরবর্তীকালে সেগুলো
ধর্ম-নির্ভর দর্শনে পরিণত হয়। আমি কোন প্রথাগত ধর্মে বিশ্বাস করি না। স্রষ্টা
থাকতেও পারেন, কিন্তু শাস্ত্র থাকবে তার কোন মানে
নেই। স্রষ্টা থাকলেই তাঁর উপাসনার প্রয়োজন আছে, এটাও
আমি বিশ্বাস করি না। বিবাহপূর্ব দৈহিক সম্পর্কে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি পরলোক
বিশ্বাস করি না, তাই আমার মৃত্যু ভয় নেই। শাস্ত্রীয়
আচার-আচরণ সবটাই কুসংস্কার।'-ডঃ আহমদ শরীফের সাক্ষাৎকার, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১৫/২/৮৫।
“ইসলাম একটি বিদেশী সংস্কৃতি। তোমরা ইসলাম ছাড়, আমরা
বিদেশ ছাড়াবো। আমাদের মুসলমান বানিয়ে বেহেশতে পাঠাবার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? আমাদের এখন নাস্তিকতা অনুশীলন করতে হবে।' -ডঃ
আহমদ শরীফ, ৩/২/৮৯ দৈনিক মিল্লাত ।
‘১৯৭৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে বিসমিল্লাহ যোগ করায় বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান
অপবিত্র হয়ে গেছে এবং আমরা মনুষ্যত্ব হারিয়েছি।' -ডঃ আহমদ শরীফ। বাংলা একাডেমীর আলোচনা সভায় সভাপতি হিসাবে ভাষণ ২১/২/৯২।
'ইহুদী-খ্রিস্টান-মুসলিম বিশ্বাস করে লোহিত সাগর মুসার দলের পলায়নের জন্য
শুকিয়ে যায় । ...যদিও আজকাল নিরক্ষর লোকও জানে, গোটা
পৃথিবীময় নদী-সাগর, উপসাগর ও মহাসাগর অবিচ্ছিন্নভাবে
জলময়, তা আংশিকভাবে শুকনা কিংবা শোষণ করা অসম্ভব। কাজেই
এটা অজ্ঞ মানুষের কল্পনাজাত বানানো গল্প, তেমনি
আবাবিলের ঠোঠচ্যুত কাঁকড় কণার আঘাতে আব্রাহাম বাহিনীর বিনাশ। অজ্ঞ লীলাবাদী
মানুষের বিশ্বাসযোগ্য অদ্ভুত বানানো গল্প মাত্র। একালে এসব অচল ও অবিশ্বাস্য
হওয়ারই কথা। -ডঃ আহমদ শরীফ, কবি মতিউর রহমান খান পঞ্চম
স্মারক বক্তৃতা ২রা ও ৩রা মার্চ ১৯৯২, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ।
'মূর্খতা ও মুসলমানিত্ব অভিন্নার্থক। যে জ্ঞানী সে নাস্তিক । পৃথিবীতে এমন কোন
অপকর্ম নেই যা আস্তিকেরা করেনি। যে কোন আস্তিকের চেয়ে একজন নাস্তিক সব সময়ই ভাল।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ইসলাম টিকে আছে ইতর ও অজ্ঞানদের মধ্যে।' (-ডঃ আহমদ শরীফ, জাতীয় জাদুঘর শিশু মিলনায়তনে
প্রদত্ত ভাষণ, ২১/১০/৯২ বুধবার। ২৫/১০/৯২ তারিখে
দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়)।
‘আসলে আমরা জাতি হিসাবেই বন্ধ্যা। আমরা পুরানোকেই আঁকড়ে ধরে আছি। যুক্তি মানি
না, নতুনকেও জানতে চেষ্টা করি না। অথচ কোন পুরানোতেই
কোন জৌলুস নেই, কোন উপভোগ নেই।' -ডঃ আহমদ শরীফ, ৫/১২/৯৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টি,এস,সি সেমিনার কক্ষে স্বদেশ চিন্তা সংঘ আয়োজিত প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃত ।
'নাস্তিক না হলে নারীরা স্বাধীনতা পাবে না। নারীদের নাস্তিক হওয়া উচিত। পৃথিবী
কোন শাস্ত্রে নারী স্বাধীনতা নেই। বিজ্ঞানের যুগে কেউ স্বধর্ম মেনে চলতে পারছে না।
গায়ের জোরে আমরা আস্তিক। অশিক্ষিত লোকের সন্তানরা মাদ্রাসায় পড়ে। লেখাপড়া জানা
কিন্তু মনের দি থেকে অশিক্ষিত কিছু লোক
সারা
দিন তসবীহ জপে এবং কপালে দাগ ফেলে। -ডঃ আহমদ শরীফ, ২৭/৪/৯৪, দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয় ২৮/৪/৯৪ তারিখে। ডঃ বি আর আম্বেদ করের ১০৩তম
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাত্রদের সংগঠন 'বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়ার্ড ক্লাস অর্গানাইজেশন' আয়োজিত
আলোচনা সভায় ডঃ আহমদ শরীফের প্রদত্ত ভাষণ থেকে উদ্ধৃত।
'মর্ত্য জীবনই হল বাস্তব। এর মধ্যে কোন প্রকার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কোন
অনুমানের অবকাশ নেই। ইসলামের বিভিন্ন ইমাম বিভিন্ন মত ও পথ সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং ধর্ম বলতে এমন কোন কিছু নেই।' ২০শে
জুলাই ১৯৯৪ বুধবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি
মিলনায়তনে কর্নেল তাহের সংসদের উদ্যোগে 'রাজনীতিতে
ধর্মের ব্যবহার গণতন্ত্রের সংকট' শীর্ষক সেমিনারে সভাপতির
বক্তব্যে ডঃ আহমদ শরীফ একথা বলেন ঃ দৈনিক সংগ্রাম ২১/৭/৯৪ ।
“স্রষ্টা থাকলেই শাস্ত্রও থাকবে কিংবা স্রষ্টাকে মানলেই শাস্ত্রকেও মানতে হবে, এমন বিশ্বাসে কিংবা দাবিতে চিন্তার বা যৌক্তিক চেতনার সমর্থন মেলে না। কেননা
আমরা দেখেছি আদিম ও আদি মানবেরা যেসব দেবতা মানত, শাস্ত্রীয়
যেসব আচার-আচরণ, পুজা-উপসনা ও পার্বণিক অনুষ্ঠান করত, সেগুলো পরবর্তীকালে তাদেরই বংশধরদের কাছে মিথ্যা, ভুল ও হাস্যকর-বিশ্বাস ও আচার বলে অবজ্ঞেয় ও পরিচার্য হয়েছে, তেমন পরিহার-প্রক্রিয়া আজো চলছে নানাভাবে বিভিন্ন সমাজে।'(কালের দর্পনে স্বদেশ : ১০৬)
‘ধর্মীয় মতবিরোধ ও অসহিষ্ণুতায় এবং স্বশাস্ত্রীয় মতগত কোন্দলে আজ অবধি
পৃথিবীতে যত রক্তপাত হয়েছে, মানুষে মানুষে যত
দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ টিকিয়ে রেখেছে, যত
প্রাণহানী ঘটেছে, এমনটি কোন
খরা-ঝড়-বন্যায়-ভূকম্পনে-মহামারীতে কিংবা সামাজিক যুদ্ধেও সম্ভব হয়নি।' (কালের দর্পনে স্বদেশ : ১০৬)
“জ্ঞান-প্রজ্ঞা-বুদ্ধি প্রয়োগে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, সচ্চিদানন্দ স্ৰষ্টা চির অজয়, অমর
হলেও শাস্ত্র চিরন্তন হতে পারে না। স্বয়ং স্রষ্টাই স্থানে স্থানে, কালে কালে নব নব নবী-অবতার মাধ্যমে তাঁর বাণী ও বিধান বদলেছেন, দেশ-কাল-পাত্রের উপযোগী করে জারি করেছেন নতুন বিধি নিষেধ। এ সত্যের, তথ্যের ও উপলব্ধির আলোকে আজ যদি মানুষ কেবল স্রষ্টার অনুগত তথা উপাসক হয়, কালিক ও স্থানিক প্রয়োজনে তৈরি শাস্ত্রকে অবহেলা করে অথবা স্বদেশের স্বকালের
স্বসমাজের মানুষের জীবন-জীবিকার ও পরিবর্তমান জীবন যাত্রা পদ্ধতির অনুগত করার
লক্ষ্যে গ্রহণে-বর্জনে শাস্ত্রের সংস্কার করে (প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সংবিধান যেমন
সংশোধন করা হয়) তাহলে আজকের পৃথিবীর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মানবিক সমস্যার অনেকগুলোর
সমাধান সহজে মিলবে।' (কালের দর্পণে স্বদেশ : ১০৬ )
‘অথচ আমরা জানি, প্রলোভন প্রবল হলে স্রষ্টার উপস্থিতি
সর্বত্র এবং তিনি অন্তর্যামী জেনেও মানুষ লোকনিন্দার ও শাস্তির ভয় এড়িয়ে গোপনে
সব পাপ কর্মই করে। তখন স্রষ্টা ও শাস্ত্র তাকে সংযত ও বিরত রাখতে পারে না । কাজেই
মানুষের শাস্ত্রানুগত্য আসলে পাপ-ভীতিপ্রসূত নয়, লোকাচারের
অনুগত থাকার সামাজিক ভড়ং মাত্র' । (কালের দর্পনে স্বদেশ :
১০৭)
‘সবাই জানি, কামে-প্রেমে, মানুষ কখনো দেশ-জাত-জন্ম-বর্ণ-ধর্মের বাধা মানেনি, অর্থ-সম্পদ অর্জনেও ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা মনে রাখেনি । অভাবে অকালে যেমন
খাদ্যাখাদ্যের বিচার করেনি, এ যুগে দেশে-বিদেশে, শহরে-বন্দরে, অশনে বসনে, নিবাসে -নিদানে, আচারে-আচরণে, ভাব-চিন্তা-কর্মে কোথাও কারুর শাস্ত্র নির্দেশিত স্বাতন্ত্র্য ও নিয়ম-নীতি
মানা সম্ভব হচ্ছে না। তবু মানুষ নাস্তিক হয়নি। পাপের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছে বলেও
গ্লানিবোধ করে না।
আজকের
দিনে কালিক ও স্থানিক জীবন-জীবিকার প্রতিবেশ-বিরোধী শাস্ত্রীয় নিয়ম-নীতি পরিহার
করা জীবন পথের ও জীবন যাত্রার বিঘ্ন অপসারণের নামান্তর মাত্র। এ উপলব্ধি যে মানব
মুক্তি ঘটাবে, তা সামগ্রিক ও সামষ্টিকভাবে মানুষের
মনুষ্যত্বের এবং মানবিক মূল্যবোধের দ্রুত বিকাশ ঘটাবে, যা গোড়ায় ধর্ম শাস্ত্রেরও ছিল মূল লক্ষ্য।' (কালের দর্পনে স্বদেশ : ১০৭-১০৮)
শাস্ত্রের
প্রতি নির্বিচার আনুগত্য পরিহার ও মুক্ত বুদ্ধি প্রয়োজন । (কালের দর্পনে স্বদেশ :
১০৮)
‘নাস্তিক হওয়া সহজ নয়। এ এক অনন্য শক্তির অভিব্যক্তি। কেননা বিশেষ
জ্ঞান-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও মনোবল না থাকলে নাস্তিক
হওয়া যায় না।
“কেবল মুখে আস্তিক্য প্রমাণ করে অর্থাৎ পুরনো রীতিনীতি নীরবে মেনে নিয়ে যে কোন
চরিত্রহীন দুরাচারী সহজে সাদরে ঠাঁই পায়। যদিও এরাই সামাজিক জীবনে যন্ত্রণা
সৃষ্টির জন্য দায়ী।' -ডঃ আহমদ শরীফের ‘যুগ যন্ত্রণা' প্রবন্ধ বইয়ের ১ম পৃষ্ঠা থেকে
উদ্ধৃত। ১৯৭৪ সালে ঢাকার চৌধুরী পাবলিশিং হাউস থেকে পুস্তকটি প্রকাশিত হয় ।
বিগত
হাজার বছরের মধ্যে দেশী মুসলমানের জীবনের কোন ক্ষেত্রেই তেমন কোন কৃতিত্ব ও
কীর্তির সম্মান মেলে না-প্রাগুক্ত-২৫ পৃষ্ঠা ।
‘ধর্ম, বর্ণ, জাত
ও ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে বিঘ্নিত করার ইতরতা পরিহার না করলে মানুষের এই দুঃখ থেকে
নিষ্কৃতি নেই । তাই তো সমাজে, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, শিল্পে কিংবা রাজনীতি বা অর্থনীতিতে
ধর্মের দৌরাত্ম্য।' যুগযন্ত্রণা-পৃষ্ঠা-২৯ ।
'কুরআন মুখ্যত ও বাহ্যত আরবদের জন্য এবং গৌণত ও স্বরূপগত বিশ্ব মানবের
উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ। কুরআনের বক্তব্য, বিষয়
কয়েকটি মাত্র, কিন্তু সব কথাই পুনরাবৃত্ত হয়ে
স্ফীত কলেবর হয়েছে'-যুগযন্ত্রণা-পৃষ্ঠা ২৯ ।
‘অজ্ঞ, অসহায়, অক্ষমের বিশ্বাসের বিস্ময়ে, কল্পনায় যে ধর্মবোধের জন্ম, আবেগে, অনুভবে ও ভীরুতায় যার লালন, সংস্কারে ও সভায় স্বীকৃতিতে যার স্থিতি এবং ত্রাস শংকায় যার চিরায়ু, সেই শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রাণ মূলে বৈনাশিকে আঘাত হেনে ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে
উদাসীন করেছেন মুখ্যত কার্লমার্কস্ই, বিজ্ঞান
বা দর্শন নয়। কেন না বিজ্ঞান দর্শনের ছাত্ররা আজো আস্তিক । আজো দুনিয়াব্যাপী
নাস্তিকের আত্মশক্তিই মানুষের জন্য সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান নতুন ভুল রচনা করেছে।’ ‘যুগ যন্ত্রণা'-৫৭ পৃষ্ঠা ।
নাস্তিকদের
জন্য অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত
ডক্টর
আহমদ শরীফের ইন্তেকাল হয়নি, তিনি ইন্তেকাল করেননি ।
ইন্তেকাল অর্থ শুধু মৃত্যু নয়, অস্থায়ী ঠিকানা থেকে স্থায়ী
ঠিকানায় ট্রান্সফার হওয়া । অর্থাৎ যিনি ইন্তেকাল (মুসলমানদের ক্ষেত্রে) করেন, তাঁকে কবরে রেখে আসল ঠিকানার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিধি অনুসারে শেষ বিদায় দেয়া
হয়। ডঃ আহমদ শরীফের ক্ষেত্রে এ কাজ করা হয়নি। এমন করতে তিনি জীবিতাবস্থায়
নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখেন। সুতরাং বলা যায়, তিনি
ইন্তেকাল করেননি । তিনি যে ‘মরহুম' এ কথাও বলা যাবে না। বলা যাবেনা এ কারণে যে, ‘মরহুম'-এর অর্থ হলো এই, যিনি আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত। মৃত্যু আল্লাহর তরফ থেকে মোমিনের জন্য রহমতস্বরূপ।
ডঃ আহমদ শরীফ ছিলেন পুরোপুরি নাস্তিক। নাস্তিক মানে আল্লাহতে যার বিশ্বাস নেই, দ্বীন মানেন না। মুসলমান নাম নিয়ে মুসলিম মা-বাবার গর্ভে ও ঔরসে জন্ম নিয়ে
জীবনের একটা পর্যায়ের পর যে নাস্তিক হয়ে যায় এবং নাস্তিক হয়েই মৃত্যু বরণ করে, এমন নাস্তিকের মৃত্যু আল্লাহ ‘রহমত’ নয় বরং আল্লাহর তরফ থেকে এক গযব। এ মৃত্যু অভিশপ্ত মৃত্যু। ডঃ আহমদ শরীফ
নাস্তিক হয়েই মৃত্যু বরণ করেছেন । অতএব তার ক্ষেত্রে আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির কোন
প্রশ্নই উঠতে পারে না। তিনি ইন্তেকালে নেই, মরহুমে
নেই, তবুও তিনি প্রায় অক্ষত অবস্থায় (চোখ দুটি
ছাড়া) ১৯৯৯ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
হিমঘরে। এ পিরিয়ডকে অনেকে বলতেন 'লাশ
ছিল ট্রানজিট ক্যাম্পে।' বেচারার লাশ নিয়ে ওয়ারিশরা
কম দৌড়াদৌড়ি করেননি। লাশ তারা প্রথমে দিতে চেয়েছিলেন সলিমুল্লা মেডিক্যাল কলেজে, কিন্তু সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ এ লাশ নিতে রাজি না হওয়ায় ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ লাশ
গ্রহণে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। এ দু'টি
কলেজে ব্যর্থ হওয়ার পর আরও দু'তিনটি কলেজে লাশ দেয়ার
চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সে সব কলেজ কর্তৃপক্ষ লাশ গ্রহণ করেননি। অতঃপর বাংলাদেশ
মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পরই তার লাশ এই কলেজ
ল্যাবরেটরিতে ডিসেকশনের জন্য চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যে সব ছাত্র লাশ
ব্যবচ্ছেদ করবে তারা বেঁকে বসে। তারা সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়, এ লাশ স্পর্শ করবে না । ফলে পরবর্তী ব্যাচের অপেক্ষায় লাশ হিমঘরে পড়ে থাকে ।
১৯৯৯
সালের ১লা জুলাই থেকে ডঃ আহমদ শরীফের মরদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজ শুরু হয়। এ কাজ
পর্যায়ক্রমে চলে কয়েক মাস। মস্তিস্কটি আগেই সংরক্ষিত করা হয়। ব্যবচ্ছেদের প্রথম
পর্যায়ে ছাত্ররা তার মরদেহের চামড়া তুলে নেয়। তারপর ছুরি-চাকু চার্লাতে শুরু
করে। এই কাটাকাটিও শেষ হয়ে গেছে বেশ আগে। তার হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, অস্ত্র, কিডনি, মূত্রথলিসহ বিভিন্ন ধরনের ভিসেরা
কলেজের ল্যাবরেটরিতে রাখা হয়েছে। দেহের সব মাংস হাই পাওয়ার কেমিক্যাল দিয়ে
ধ্বংস করা হয়েছে। থেকে যায় শুধু হাড্ডি। এই হাড্ডি এখন সংরক্ষণে আছে, না কোন আস্তাকুড়ে, না মাটির নিচে আছে তা আর জানি
না।
জীবিত
থাকতে তিনি লিখিতভাবে অসিয়ত করে যান, মৃত্যুর
পর তিনি না যাবেন গোরে, না যাবেন শ্মশানে আর না নেবেন
ধর্মীয় বিধানে সৎকারের আনুষ্ঠানিকতা। এ কারণে তার লাশ না গেল গোরে আর না গেল
শ্মশানে । নিজ দেহকে মৃত্যুর পর দান করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন, সে দৃষ্টান্ত এ দেশে দ্বিতীয়। প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বরিশালের আরজ
আলী মাতবর নামক এক ব্যক্তি। তিনি আদালতে গিয়ে নিজের দেহকে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে দানের উইল করে যান। ডঃ শরীফও একই কায়দায় আরজ আলী মাতবরের পথ অনুসরণ
করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (জনাব এম
আফজালুর রহমান) আদালতে একটি অসিয়তনামায় স্বাক্ষর করেন। সেই অসিয়তনামায় ডঃ শরীফ
বলেন, আমার দেহ দানের বিষয়ে আমার স্ত্রী ও পুত্রগণের
সম্মতি আছে। ডঃ শরীফের মৃত্যুর পর এই অসিয়তনামা তার বড় ছেলে ও কন্যা বাংলাদেশ
মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের এ্যানাটমি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এম আর সরকারের
কাছে হস্তান্তর করেন।
কেউ
কেউ তো কৌতুক করে বলেন, তিনি কবরের আযাব থেকে বেঁচে
গেলেন। ফেরেশতাদের নানা সওয়াল-জওয়াবের সম্মুখিন হলেন না। এই রসিকজনেরা এ কথা
দ্বারা কি এই বুঝাতে চান যে, লাশ কবরে না রাখলেই কবরের
আযাব হবে না? পানিতে ডুবে মরা মানুষের যে সব লাশ
পানিতে পচে গলে মিশে যায় বা অন্যভাবে মরার পর লাশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তারা কি কবরের আযাব থেকে মাফ পেয়ে যান? শ্মশানে
যাদের লাশ দাহ করা হয়, এদের ব্যাপারে এই রসিকজনদের
রায় কি একই? যদি এ মন্তব্য রসিকতা না হয়, তাহলে বলবো, রূহের আযাব সম্পর্কে তাদের কোন
ধারণাই নেই। এখন যে ধারণা তারা পোষণ করছেন, সে
ধারণার আগাগোড়া গলদ। রূহের খাঁচাটাকে তারা আসল মানুষ ভেবে বসে আছেন। মানুষের ভিতর
থেকে রূহ চলে গেলে লক্ষ্য করে দেখবেন, সেই
মানুষের গোটা দেহ অবিকৃত ও অক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে। তখন তার চোখ থাকে কিন্তু সে
চোখ কিছুই দেখে না। হাত দু'খানা থাকে, কিন্তু হাত নাড়াতে পারে না। পা থাকে কিন্তু হাঁটতে পারে না। মুখ-জিহ্বা সবই
থাকে কিন্তু কথা বলতে পারে না। রূহবিহীন লাশে আঘাত করলে সে লাশ আহ-উহ করে না।
নিস্তেজ, নিঃস্তব্ধ, অসাড়। অথচ বিপরীত পক্ষে রূহ ধারণ করে আছে যে দেহ, সে দেহ যত রোগা ও দুর্বল থাকুক না কেন, হালকা
একটি চিমটি দিলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। তাহলে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি
যে, রূহটিই হলো মূল। দেহে রূহ থাকলেই অনুভূতি থাকে ।
অতএব আযাব, শান্তি, শাস্তি সবই রূহের সঙ্গে যুক্ত। রূহবিহীন খাঁচার কোন মূল্য নেই বলেই খাঁচার
ওয়ারিশরা দ্রুত এ খাঁচাকে কবরস্থ করেন। ইসলামের বিধানও তাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবরস্থ করতে হবে। এ কথা কি আমরা মেনে নেব না যে, যে রূহের শাস্তি আল্লাহ কবরে দিতে পারেন দেহসহ, এ
আল্লাহ কি রূহকে দেহবিহীন অবস্থায় কবরের বাহিরে শাস্তি দিতে পারেন না? যে আল্লাহ দেহ ও রূহ পয়দা করেছেন, সে
আল্লাহ এই রূহকে আবার তার দেহ তৈরি করে আযাবের স্বাদ পরখ করাতে কি পারেন না? অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি, আহমদ
শরীফের লাশ, আহমদ শরীফ নন। আসল আহমদ শরীফ হচ্ছে তার
রূহ, যা চলে গেছে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই।
ডঃ
আহমদ শরীফ গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি (১৯৯৯) মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটে
হৃত্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। অবশ্য হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে কেউ
বাঁচে না। সুতরাং এটা কোন রোগ নয়। হৃত্যন্ত্রের ক্রিয়া চালু অবস্থায় কেউ মরে না
এবং এ অবস্থায় কাউকে মৃত ঘোষণাও করা হয় না। যা হোক, ডঃ আহমদ শরীফের মৃত্যুর তারিখ ও বার ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সময় অনুযায়ী ২৪শে
ফেব্রুয়ারি এবং বার বুধ হওয়ার কথা। কারণ, রাত
১২টার পর থেকেই অন্য বার শুরু হয়। তিনি মারা যান ১টা ৪০ মিনিটে। এ সময়টাকেও সঠিক
সময় বলা যায় না। চিকিৎসকদের থেকে মৃত্যু ঘোষণা এসেছে ১টা ৪০ মিনিটে। তিনি বাসা
থেকে রওয়ানা হয়ে হাসপাতালে আসার পথে কত মিনিটে কোন্ জায়গা অতিক্রম করা অবস্থায়
মারা যান, তা কেউ বলতে পারেন না । তবুও ধরে
নিলাম তিনি ২৪শে ফেব্রুয়ারি বুধবার রাত ১টা ৪০ মিনিটেই মারা গেছেন ।
তিনি
জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার সুচক্রদন্ডী গ্রামে ১৯২১ সালের ১৩ই
ফেব্রুয়ারি রোববার। এই হিসাবে তিনি এই দুনিয়াতে বেঁচেছিলেন প্রায় ৭৮ বছর।
জীবনের এই মুদ্দতে তিনি ৪০ খানা মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন, যার অধিকাংশই বিতর্কিত । জীবিত থাকতেই তিনি চোখ দিয়েছেন সন্ধানীকে। আর
খাঁচাটা দিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার জন্য । কিন্তু
রূহটা তিনি কোনও সংস্থায় দান করেননি বা দানের চিন্তাও করতে পারেননি। তিনি হয়তো
মনে করেছিলেন, এ ক্ষেত্রে কোন বক্কর-চক্কর কাজে
লাগবে না। এ রূহটা যিনি দিয়েছেন, তিনি সেটা ফেরত নিয়েছেন।
মালেকুল মউতের কাছে কোন যুক্তি খাটে না। মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কে তার ধারণা কি ছিল, তা অনেকেই জানেন। এ জন্য বোধহয় তার মৃত্যু সংবাদ শুনে কেউ ইন্নালিল্লাহও
পড়েননি। যিনি ইন্তেকাল করেননি, তার ওপর ইন্নালিল্লাহ পড়ার
তো প্রশ্নই উঠে না। মুসলিম নামের যে কোন মুরতাদ বা নাস্তিক মারা গেলে টেলিভিশনে
সংবাদ পরিবেশনের প্রায় শুরুতেই ইন্নালিল্লাহ উচ্চারণ করা হয়।
কিন্তু
আহমদ শরীফের ব্যাপারে দেখা গেল ইন্নালিল্লাহ ছাড়া মৃত্যুর খবর পরিবেশন করা হয় ।
তিনি
নাকি মানবতাবাদী ছিলেন। হ্যাঁ, যারা সব বাদ দেয়, তারা শেষ অবলম্বন হিসাবে একটি 'বাদ'ই নিয়ে থাকে। আর সেটা 'মানবতাবাদ'। তিনি যখন এতই মানবতাবাদী ছিলেন, জীবিতাবস্থায়
তার উচিত ছিল শিয়াল-শকুনের আহার হিসাবে নিজ দেহ ওয়াকফ করে যাওয়া। তাহলে
মানবতাবাদী হওয়ার সাথে সাথে তিনি পশুপাখীবাদীও হতে পারতেন। আমাদের বন-জঙ্গলের
পশুদের আহারের বড়ই অভাব। এই বিরাট দেহ তাদের কয়েক দিনের খোরাক হতো। ডঃ আহমদ
শরীফের মৃত্যুর আদর্শ অনুসরণ করে দেশের যে সব নাস্তিক মরবে তাদের উচিত হবে মৃত্যুর
আগে নিজ নিজ দেহ সুন্দরবনের পশুপাখীর আহার হিসাবে দান করে যাওয়া। তাহলে তারাও
মরার পর মানবতাবাদী হওয়ার সাথে সাথে পশুবাদী বলে গণ্য হবেন। তিনি লাশটাকে এমন এক
স্থানে কাটাকুটার জন্য দিলেন, যেখানে লাশের কোন অভাব নেই।
অনেক লাশ ওয়ারিশরা নিতেও আসে না। তাছাড়া লাওয়ারিশ লাশ এ দেশে অনেক পাওয়া যায়।
এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মনে হয়, তার লাশের সযত্ন ব্যবহার হবে
মাত্র কয়েক দিনের জন্য। তার রূহ আসল ঠিকানায় ঐ রাতে ১টা ৪০ মিনিটে চলে গেছে। এখন
এই রূহটি আসল কায়ায় প্রবেশ করে বিগত ৭৮ বছরের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে । তিনি
নিজের ব্যালেন্সশীট নিয়েই অত্যন্ত বিপদে আছেন। অডিও-ভিডিও করা পূর্ণ জীবন-ফিল্ম
এখন তিনি দেখছেন আর উৎকণ্ঠায় উৎকণ্ঠিত হয়ে আযাবের কঠিনতম জ্বালায় জ্বলছেন ও
ভুগছেন ।
ডঃ
আহমদ শরীফের চিন্তাধারা তথা জীবন দর্শনে বিশ্বাসী এ দেশে অনেকেই আছেন। তারা যদি ডঃ
আহমদ শরীফের মত বে-ঈমানে পাক্কা ঈমানদার হন আর তারই মত সমআদর্শে আদর্শবান হন, তাহলে এই আদর্শবানরা নিজেদের দেহ বন-জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার, শিয়াল-শকুনদের জন্য দান করে যেতে পারেন। ডঃ আহমদ শরীফের মত হাসপাতালে দান
করলে নতুন ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে ।
ডঃ
আহমদ শরীফ যে মুসলিম নামের অন্যান্য নাস্তিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম নাস্তিক, তিনি তা প্রমাণ করে গেলেন। আমার মনে হয়, তিনিই
বাংলাদেশের একমাত্র ব্যতিক্রম নাস্তিক, যার
কথার সঙ্গে কাজের মিল আছে, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক
আছে। এমন নাস্তিক বাংলাদেশে আমার জানা মতে আর একজনও
ছিলেন
না। বাংলাদেশে মুসলিম নামের যত নাস্তিক এ পর্যন্ত মারা গেছেন, তাদের কোন একজনও মৃত্যুর আগে এ কথা ঘোষণা করেননি যে, আমার মৃত্যুর পর আমার লাশ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যেন সমাহিত করা না হয়। আমার
লাশ যেন গবেষণার জন্য হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। এই রাজধানীর বড় বড় সব নাস্তিক
বায়তুল মোকাররম এসে জানাযা নিয়েছেন। এর অর্থ হলো, জীবিত
থাকতে মৃত্যুর পর তারা জানাযা না নেয়ার কথা ঘোষণা করেননি। ডঃ আহমদ শরীফ ছাড়া আর
কোন নাস্তিককে (যারা মারা গেছেন) কথায়, কাজে
বা জীবনে-মৃত্যুতে এক দেখিনি। প্রত্যেকেই জীবনের বিশ্বাসের সঙ্গে মৃত্যুর
মধ্যদিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এ দ্বারা এ সত্যই প্রমাণিত হয় যে, তারা জীবিত থাকতে মানুষের মাঝে যা বলে বেড়াতেন বা মানুষকে যে পথে আসার আহ্বান
করতেন, তারা কিন্তু তলে তলে প্রচারিত বা অনুশীলিত
বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন না। অথবা এও হতে পারে যে, জীবিত থাকাকালীন তাদের বিশ্বাসের যে পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাদের মরণের পর বুঝতে পারলাম, জীবিতকালীন তাদের যে বিশ্বাস
ছিল, তা ছিল বৈষয়িক স্বার্থনির্ভর। জীবন-জীবিকা, হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা মাত্র। অর্থাৎ কন্ট্রাস্ট, বৈপরিত্যের জীবন। মৃত্যুর পর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা দ্বারা তাদের সমাহিত হওয়া
কন্ট্রাস্টের নগ্নরূপ ।
আহমদ
শরীফ বাংলাদেশের সকল নাস্তিকের জন্য এক মডেল। যে মডেল অন্যান্য নাস্তিকের জন্য
অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। বাংলাদেশের সর্বস্তরের নাস্তিকদের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনারা নিজ নিজ বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ ঈমানদার হয়ে যান। মুনাফিকের চরিত্র
ত্যাগ করুন। আহমদ শরীফের আদর্শকে আপনারা মডেল হিসাবে গ্রহণ করে ঘোষণা করুন, আমরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করি না। মৃত্যুর পর আমাদের লাশ যেন কোন ধর্মীয় বিধান
অনুযায়ী সৎকার না হয় । আমাদের এত লাশ যদি হিমঘরে রাখার মত জায়গা না হয়, তাহলে সুন্দরবনে রেখে আসবেন অথবা লাশগুলোর ওপর বিভিন্ন দাহ্য কেমিক্যাল
ছিটিয়ে ধ্বংস করে দেবেন। মৃত্যুর পর আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব
যেন আমাদের উদ্দেশে কখনো কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান না করেন।
তারা
এ ঘোষণা করতে পারেন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ইশতেহার প্রকাশ করে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তাদের
সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে। অথবা তারা ব্যক্তিগতভাবেও নিজ নিজ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে
পারেন। তাতে দুটি সুফল পাওয়া যাবে ।
১.
কেউ তাদের মুনাফিক বলবে না, নিজ আদর্শের প্রতি
বিশ্বাসঘাতক বলবে না, নাস্তিক্য আদর্শে তারা যে
নিষ্ঠাবান ছিলেন না, এ কথা বলার মত সুযোগও কেউ পাবে না।
২. দ্বিতীয় সুফল হচ্ছে এই, আমাদের গোরস্থানগুলোতে
এমনিতেই ‘ঠাই নেই ঠাঁই নেই' অবস্থা। তারা এমন ঘোষণা দিলে গোরস্থানগুলোর উপর চাপ কম পড়বে। অপরপক্ষে তাদের
লাশগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করে ময়লা-আবর্জনায় রূপান্তরিত করে
অনেক খাদ-খন্দক ভর্তি করা যাবে।
সুতরাং
তাদের উচিত, আর কালবিলম্ব না করে ডঃ আহমদ শরীফের
আদর্শ অনুসরণ করে অনুরূপ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা। এ চিন্তাধারায় যারা দৃঢ় বিশ্বাসী
বলে দাবি করেন, তারা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে এই
দৃঢ়তার প্রমাণ রাখুন। তাহলে মুসলমানদের প্ল্যাটফরম অনেকটা আবর্জনামুক্ত হয়।
আস্তিক নাস্তিক চিনতেও ভুল করবে না কেউ। ডঃ আহমদ শরীফের এই ঘোষণা থেকে তারা শিক্ষা
লাভ করতে পারেন, যারা আমাদের মধ্যে আছেন খলল্ ঈমান
নিয়ে, তারা ডঃ আহমদ শরীফ থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করতে
পারেন যে, ডঃ শরীফ তার ভ্রান্ত চিন্তাধারা ও
বিশ্বাসের প্রতি যদি এত সুদৃঢ় হতে পারেন, তাহলে
তারা তাদের ছহী-শুদ্ধ ঈমানের প্রতি ডঃ শরীফের চেয়ে দ্বিগুণ ঈমানদার হতে বাধা
কোথায়? ঈমানদার দাবি করলে হতে হবে পাক্কা
ঈমানদার। আর যদি বে-ঈমানদার হতে হয় তাহলে ডঃ আহমদ শরীফের মত পাক্কা বেঈমানদার হতে
হবে নিজ বেঈমানীতে। আল্লাহ বলেন, পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল
হয়ে যাও। এখানে পার্ট টাইম বা আংশিক দাখিলের কোন অবকাশ নেই এবং তা গ্রহণও করা হয়
না।
ডঃ
আহমদ শরীফকে ধন্যবাদ তার বিশ্বাসের দৃঢ়তার জন্য। একটা অনাকাংখিত লাশের জায়গা
দেয়া থেকে গোরস্থান তো বাঁচলো। আমি তাকে ধন্যবাদ দেই আর একটি কারণে। তা হচ্ছে, নাস্তিক্যবাদের জনক বা গুরুকেও তিনি আদর্শের প্রতিযোগিতায় হারাতে সক্ষম হলেন।
তার গুরু কার্ল মার্কস মরার পর গোরে গিয়ে প্রবেশ করেছেন। বিলেতে তার কবর এখনও বিদ্যমান
। ডঃ শরীফ গুরুর স্তরও অতিক্রম করলেন। তিনি অবশ্য লেনিনের পথ অনুসরণ করেছেন।
কিন্তু লেনিনের লাশ ৭৬ বছর ধরে রাশিয়া জোড়াতালি দিয়ে শুইয়ে রাখছে। কিন্তু আহমদ
শরীফের লাশ কোন্ ময়লার ভাগাড়ে চলে গেছে, তা
কে জানে? লাশের পরিণতি যাই হোক, তিনি যে হিপোক্রেট নাস্তিক নন, নাস্তিক্যবাদে
গুরু মারা বিদ্যা ও নিষ্ঠা অর্জন করেছেন, তা
তিনি প্রমাণ করে গেলেন। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে তার নাম স্থান পাওয়া উচিত ছিল।
একটি
লাশই এক ইতিহাস
[ডঃ আহমদ শরীফ মৃত্যুর পরই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন
[আগের লেখাটি শেষ করার পর একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, তার লাশ কোন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, আরও কিছু কিস্সা-কাহিনী শুনলাম, তাই
এই লেখাটি লিখতে হলো-লেখক]
একটি
লাশ নিয়ে কেন এত ঝামেলা হচ্ছে? এই কেন-এর মন-পছন্দ উত্তর
পাচ্ছি না। একজন সাধারণ মানুষের লাশ নয়, এ
লাশ ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক অধ্যাপকের। যিনি বাম
বুদ্ধিজীবী তালিকাভুক্ত এবং মানবতাবাদী বলেও কথিত । আমি ডঃ আহমদ শরীফের লাশের কথাই
বলছি। আহ! বেচারার লাশের কি দুর্গতি! না গেলেন তিনি গোরে, না গেলেন শ্মশানে, না থাকতে পারছেন শান্তিতে কোন
হাসপাতালের লাশ কাটা হিমঘরেও। কোথাও তার ঠাঁই নেই। কেন তাকে কেউ জায়গা দিচ্ছে না
বা কোথাও তার জায়গা হচ্ছে না? তার মত এক ব্যক্তির লাশ তো
সবখানে জায়গা হওয়া উচিত ছিল। অতি সাধারণ যে লাওয়ারিশ লাশ রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে, সে লাশেরও একটা হিল্লা হয় । আর আজুমানে মুফিদুল ইসলামের নজরে পড়লে তার একটা
সৎকার অবশ্যই হয়। কিন্তু আফসোস! ডঃ আহমদ শরীফের ক্ষেত্রে আনজুমানে মুফিদুল ইসলামও
কোন কিছু করার সুযোগ পেল না। কোন গোরস্তান বা শ্মশান কর্তৃপক্ষও আপোস রফার কোন
চান্সই পাননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পড়েছেন বেকায়দায় । লাশ কেউ নিচ্ছেন না।
জীবিত থাকতে যার এত কদর ছিল, যিনি প্রায় এক ডজন সংস্থা, সমিতি ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তার
লাশটার যে এমন অবস্থা হবে তা কি কেউ কখনো কল্পনা করেছেন? ডঃ আহমদ শরীফও কি যে ভুল করেছেন, মৃত্যুর
পর এখন তিনি সেই ভুল বুঝতে পারছেন। কিন্তু সেই ভুলের তো আর সংশোধন নেই ।
এ
সম্পর্কে ৭ই মার্চের (১৯৯৯) দৈনিক সংগ্রামে ডঃ আহমদ শরীফের ঝুলন্ত লাশের যে খবর
ছাপা হয়েছে, তা যেমন কৌতুকবহ, তেমনি বেদনাদায়ক । আমার জানা মতে, এ
দেশে এ ধরনের কোন ব্যক্তির লাশ নিয়ে ঠেলাঠেলি আর হয়নি। খবরে প্রকাশ, ডঃ আহমদ শরীফের লাশ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মারা যাওয়ার ১০
দিন পর তার মৃতদেহ নিয়ে সৃষ্টি হয় এক অদ্ভুত জটিলতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের
গবেষণা কর্মের জন্য জীবদ্দশায় তিনি
তার
লাশ দান করে গেলেও ছাত্ররা এখন তাতে হাত লাগাতে চাচ্ছে না ৷ গত চার দিন ধরে তার
মৃতদেহটি নিয়ে দুই মেডিক্যাল কলেজে ঠেলাঠেলি চলছে। ডঃ আহমদ শরীফের ইচ্ছা অনুযায়ী
(২৮শে ফেব্রুয়ারি) ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের এনাটমী বিভাগের প্রধান
প্রফেসর এম আর সরকারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। মৃত্যুর পর পরই তার চোখের
কর্ণিয়া খুলে নেয় সন্ধানী। পরে এই কর্ণিয়া এক মহিলা এবং এক অন্ধ হাফেজের চোখে
লাগানো হয়। অন্ধ হাফেজ বলেন, 'নাস্তিকের চোখ আগে জানলে তো
আমি নিতাম না।' তাকে না জানিয়েই কর্ণিয়াটি সংযোজন
করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রী তাদের গবেষণা
কর্মের জন্য আহমদ শরীফের লাশে হাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এই
অবস্থায় তার মৃতদেহটি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য
পাঠানো হয়। কিন্তু ঘোরতর আপত্তি উঠেছে সেখান থেকেও। শিক্ষার্থীরা কিছুতেই এই লাশ
গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছেন না। অগত্যা আবার তার মৃতদেহটি বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজে
ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এখন এই লাশ নিয়ে পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে।
ছাত্রদের বক্তব্য হলো, 'যে লোক জীবদ্দশায় আল্লাহকে
অস্বীকার করেছেন, এমন ব্যক্তির লাশে তারা হাত দেবেন না' ।
এই
সংবাদ পাঠ করার পর আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা ডঃ আহমদ শরীফ তার লাশের
হাল-অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই ভীষণভাবে বেদনাহত হয়েছেন এবং ভাবছেন নানা কথা। কি
ভাবছেন তিনি? এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে এক শ্রেণীর
জ্যোতিষ ও তান্ত্রিক নাকি ডঃ আহমদ শরীফের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্টারভিউ
নিয়েছেন। শুনেছি, মৃত্যুর পর অনেকের আত্মা নাকি
প্রেতাত্মায় পরিণত হয়। এসব আত্মা কোথাও ঠাঁই পায় না, শুধু ঘুরে বেড়ায়। কোন কোন জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক নাকি কি কি তন্ত্র-মন্ত্র
বলে আত্মাকে হাজির করে নানা কথা জিজ্ঞাসা করেন। আরও শুনেছি, এ ধরনের একটা শাস্ত্র নাকি আছে এবং এ লাইনে সাধনাও কেউ কেউ করেন। বাজারে তথা
পাবলিকের মধ্যে একটা কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে, ডঃ
আহমদ শরীফ কোথাও ঠাঁই না পেয়ে স্বপ্নযোগে কোন কোন স্বজনকে প্রেতাত্মার রূপ ধরে
রাতে জ্বালাতন করেন। কোন কোন জ্যোতিষ ও তান্ত্রিক মন্ত্রের জালে আটকিয়ে তার থেকে
বিলাপ শুনেছেন। স্বপ্নের ইন্টারভিউ, আত্মার
আহাজারি আর বিলাপের ভাষা ও কাহিনী নানা জনের মধ্যে নানাভাবে নানা রূপে ছড়িয়ে
পড়েছে। গভীর রাতে যারা চলাফেরা করেন, তাদের
কারো কারো সাথে নাকি দেখাও হয়ে যায়। শোনা যায়, বাংলাদেশ
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অশরীরী এই আত্মা ঘুরাফেরা করে। বিশেষ করে রাতের বেলা
ডিউটিরতদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি
নাকি তার মতাদর্শী কোন এক স্বজনের কাছে সম্প্রতি দুঃখ করে (স্বপ্নে) বলেছেন, আগে যদি জানতাম আমার লাশের এমন দশা হবে, তাহলে
শ্মশানে পুড়েই মরার কথা ঘোষণা করতাম। বাংলাদেশে পুড়ে মরা অসুবিধা হলে কলকাতার
কোন শ্মশান ঘাটে নিজেকে জীবিত অবস্থায়ই বুকিং করে রাখতাম। আমি কি এতই ফেলনা যে, কোন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরেও আমার লাশের ঠাঁই হয় না?
স্বজন
বলেছেন : আমরা তো চেষ্টা কম করছি না স্যার, কিন্তুকি
করবো বলুন, কোন হাসপাতালই তো গ্রহণ করে না ।
আহমদ
শরীফ : এ দেশে আমিই তো প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। এমন তো আর কেউ করেনি। তোমরা
কোনভাবে ম্যানেজ করে আমার লাশটা রাখার ব্যবস্থাটা করো ।
স্বজন
: আপনি মস্তবড় ভুল করেছেন স্যার। আপনি তো এক নম্বর নন, দুই নম্বর । আপনার আগের নাম্বার বরিশালের এক ভদ্রলোকের । কেন আপনি নিজের লাশকে
এভাবে দান করে গেলেন? বাংলাদেশে কি লাশের অভাব আছে? কত রোগী হাসপাতালে মরে পড়ে থাকে। কোন কোন মৃত রোগীর গরিব ওয়ারিশরা লাশ নিতেও
আসে না। কারণ, দাফন-কাফন তো খুব ব্যয়বহুল কিনা।
এছাড়া লাওয়ারিশ লাশের তো অভাব বাংলাদেশে নেই । আনজুমানে মুফিদুল ইসলামের সঙ্গে
যোগাযোগ করলে তারাই কত লাশ হাসপাতালকে দিতে পারে। আপনি এসব কথা জানেন । তবুও কেন
নিজের লাশটা এভাবে দান করলেন?
আহমদ
শরীফ : তোমার মাথায় ঘিলু 'বিলো এভারেজ' অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়েও কম। কথাটা এ জন্য বললাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, শীর্ষস্থানীয়
বুদ্ধিজীবী এবং ডক্টরেট ডিগ্রিধারী আহমদ শরীফের মত দামি লাশ গবেষণার জন্য
হাসপাতালে ক'টি আছে? এ লাশের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও মূল্য কি আলাদা নয়? সাধারণ লাশ ও লাওয়ারিশ লাশের সঙ্গে কি আমার লাশের তুলনা করো? বুদ্ধিসুদ্ধি কি তোমার নেই?
স্বজন
: বুদ্ধি আমার ঠিকই আছে, আর আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিই
বলছে, সাধারণ লাশ, লাওয়ারিশ
লাশ আর আপনার লাশের মধ্যে কোন তফাৎ নেই ।
আপনার
দেহে যেমন দুটি কিডনি আছে, তাদের প্রত্যেকের দেহে দুটি
কিডনি আছে। আপনার লাশ কাটাকুটি করলে এমন কি বস্তু অতিরিক্ত পাওয়া যাবে যা তাদের
দেহে নেই? বরং আপনার এই ৭৮ বছরের বুড়া দেহের
অনেক কলকব্জা অকেজো হয়ে পড়েছে। গবেষণার জন্য এই বুড়া দেহ উপযোগীও নয় ৷
আহমদ
শরীফ : আমার দানের এই কি প্রতিদান? জীবিত
থাকতে যখন ঘোষণা করেছি, তখন তো তোমরা বাধা দাওনি বরং
তখন হাততালি দিয়েছ । সে সময় কেন এসব কথা বলোনি?
স্বজন : আমাদের সঙ্গে যুক্তি করলে অন্য পরামর্শ দিতাম। আপনি তো আবেগে এ ঘোষণা দিয়েছেন বিখ্যাত হওয়ার জন্য। এখন তো দেখতে পারছেন আপনার লাশের কি অবস্থা? বিখ্যাত হওয়া তো দূরের কথা, মূল মহাজনী যায় ।
আহমদ শরীফ : আগে পরামর্শ করলে তোমাদের পরামর্শটা তাহলে কি হতো?
স্বজন
: আমি সাফ সাফ জবাবে বলতাম, আমাদের গুরু কার্ল মার্কসের
মৃত্যুর পরবর্তী কর্মসূচি অনুসরণের জন্য। মৃত্যুর পর তাকে সমাহিত করা হয় । আপনি
কেন তার চেয়েও কয়েক ডিগ্রি উপরে উঠতে গেলেন? নাস্তিকদের
মরার পর সৎকারের তো আলাদা কোন বিধান কার্ল মার্কস, এঙ্গেল, লেনিন, স্টালিন কেউ দিয়ে যাননি। তাদের
প্রত্যেকেই (লেনিন ছাড়া) মৃত্যুর পর দেশীয় ও ধর্মীয় প্রথায় সমাহিত হয়েছেন।
আপনি কেন ব্যতিক্রম ধারা সৃষ্টি করে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে গেলেন? দুনিয়ার প্রত্যেক নাস্তিকই মৃত্যুর পর ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকে।
আমাদের দেশের প্রত্যেক নাস্তিকই এ ধারার এক একটি দৃষ্টান্ত । আপনি দেখেননি এ দেশের
নাস্তিকরা তাদের ওয়ারিশের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী গোরে বা শ্মশানে যায়?
আহমদ
শরীফ : আমি চেয়েছিলাম একটা স্বতন্ত্র নিয়ম সৃষ্টির ।
স্বজন
: আপনার স্বতন্ত্র নিয়মের ঠ্যালাটা এবার বুঝুন। খামোখা আমাদের ঝামেলায় ফেলছেন।
আমরা এখন কি করতে পারি বলুন?
আহমদ
শরীফ : আমি এই ঘোষণা না দিলে তোমরা আমাকে গোরে নিয়ে যেতে। সেখানে মৌলবাদীরা গোলমাল
করতো। হিন্দুরাও নিত না আমাকে শ্মশানে । এই ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্যই তো এই করলাম
।
স্বজন
: এবার বলুন, আপনার লাশের কি ব্যবস্থা আমরা করতে
পারি?
আহমদ
শরীফ : আমার পৈত্রিক জেলার কোন এক পাহাড়ে বা টিলায় গর্ত করে মিসরের ফেরাউনের মত
আমার লাশকে মমি করে রেখে দাও ।
স্বজন
: এত অর্থ আমরা কোথায় পাবো?
আহমদ
শরীফ : তোমরা তো আমার গুণগ্রাহী । সবাই মিলে এতটুকু ত্যাগ স্বীকার কি করতে পারবে
না? তসলিমা আর রুশদীর শরণাপন্ন হলে আশা করা যায় মোটা
অংকের সাহায্য পাবে। জীবিত থাকতে ওদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছি।
স্বজন
: আবার চেষ্টা করে দেখি কোন হাসপাতালে একটুখানি জায়গা পাওয়া যায় কিনা। সরকার
যেহেতু আমাদের, একটা ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যেতে পারে
। তবে সরকার স্বেচ্ছায় লাশের কোন দায়িত্ব নেবে না ।
আহমদ
শরীফ : বিদেশে তো কত আস্তিক-নাস্তিকের লাশের ওপর গবেষণা হয়, লাশ তারা স্পর্শ করে কাটাকাটি করে, কোন
ছাত্রতো লাশ নিয়ে নাস্তিক-আস্তিকের প্রশ্ন তোলে না। এখানে কেন এ প্রশ্ন উঠছে এবং
প্রশ্ন উঠছে আমার লাশকে নিয়েই? কেন আমাকে নিয়ে এই উল্টা
বাতাস বইছে?
স্বজন
: আপনার নাম যে আহমদ শরীফ। জীবিত থাকতে কেন এত বাড়াবাড়ি করলেন? তারা এখন সেই বাড়াবাড়ির প্রতিশোধ নিচ্ছে। যারা আপনার নামে তখন অন্ধ ছিল, কারণে-অকারণে আপনার রেফারেন্স টানতো, তারা
এখন আপনার লাশের ঝামেলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকছে। তাদের জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমরা লাশের ঝামেলায় নেই ।
আহমদ শরীফ : তোমার মধ্যেও দেখছি এমন একটা মানসিকতা কাজ করছে।
স্বজন
: না, কথাটা ঠিক তাই,নয়।
তবে আমিও এই খামোখা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাই না ।
আহমদ
শরীফ : যে ভুল আমি করেছি। তোমরা আর এমন ভুল করো না । তোমাদের জন্য আমার উপদেশ, নাস্তিকদের জন্য আলাদা গোরস্তান তৈরি করো। সে গোরস্তানে শুধু মুসলিম নামযুক্ত
নাস্তিকদের মাটি চাপা দেয়া হবে জানাযা ছাড়া ।
স্বজন
: গুরু, তাতেও কিন্তু বিপদ আছে।
বিরুদ্ধবাদীরা সেই গোরস্তানে পেশাব-পায়খানা করে অপবিত্র করে ফেলবে। মক্কায় আবু
জেহেলের বাড়িকে টয়লেট হাউসে পরিণত করা হয়েছিল।
আহমদ
শরীফ : আমার লাশের কোন হিল্লা করতে না পারলে গোটা লাশকে কোন হাই পাওয়ার তরল
ক্যামিকেলে ডুবিয়ে তরল পদার্থে পরিণত করে ড্রেনে ঢেলে দিও । আর আমার কংকাল আমার
বাসার ফটকে লম্বা তিন বাঁশের মিলিত অগ্রভাগে উঁচু করে ঝুলিয়ে রাখবে। আমার কংকালের
এ দৃশ্য দেখে অনেকেই শিক্ষা নেবে। কারণ, আমি
যে মানবতাবাদী। মরেও তোমাদের শান্তিতে থাকতে দেবো না। স্বপ্নে এসে জ্বালাতন করবো।
ফজরের
আযানের মধুর সুর ভেসে আসে। আযান শুনলে শয়তান আর প্রেতাত্মারা পালায় । আযানের
আওয়াজ শুনে ডক্টর সাহেব কেটে পড়েন। স্বজন চমকে উঠে । তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
ডঃ
আহমদ শরীফের এই আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকের সঙ্গে নাকি দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, নিজ ভুলের স্বীকারোক্তিও করছেন। গভীর
নিশিতে নাকি কেউ কেউ ডঃ আহমদ শরীফের মোটা গলায় শোনেন (ঈষৎ পরিবর্তিত) গানের সেই
কলিগুলো কান্না বিজড়িত কণ্ঠে, যাতে রয়েছে-
ভুল
ভুল ভুল
সবই
ভুল
এ
জীবনের পাতায় পাতায়
যা
কিছু ছিল লেখা
তাও
ছিল ভুল ।
আর
কেউ করো না
এমন
সর্বনাশা ভুল ।
পরিবারের
কথা : সন্ধানী ২৪শে ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টা তার চোখ নিয়ে গেল, ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেহটি নিয়ে গেল বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ। অবশিষ্ট আর কিছুই থাকলো না। থাকলো শুধু একটি ইতিহাস, সে ইতিহাস নিয়ে দু'দশজন গর্ব করেন। কিন্তু কোটি
কোটি লোক সেই ইতিহাসের ওপর ঘৃণার থু থু নিক্ষেপ করেন। তার পরিবার কিন্তু এ ইতিহাস
গর্বের সাথে মেনে নিয়েছে। ডঃ শরীফের আদর্শে গড়া পরিবার কর্তার আদর্শপন্থী তো
হবেই ।
ডঃ
শরীফের তিন ছেলে। এরা হলেন মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানির এরিয়া সেলস অফিসার
মাহমুদ করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান
বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ নেহাল করিম ও সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট জাহেদ করিম। তারা
বলেন, বাইরের কিছু লোক ও আত্মীয়স্বজন সামাজিক ও
ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করেন। কিন্তু আমরা তিন ভাই বাবার
নির্দেশ পালনে সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমাদের বাড়িতে কোন ধর্মকর্ম পালন করা হয় না।
তবে কুরবানি হয়। কুরবানির ব্যাপারে বাবা কোন বাধা দেননি। আমাদের ভাইদের নামে
কুরবানি হয় না, কিন্তু ভাবীদের নামে হয় । [দৈনিক
মানবজমিন, ১১ই মার্চ, ১৯৯৯]
দু'চোখ : ডঃ আহমদ শরীফের দু'কর্ণিয়ায় যে দুজন অন্ধ আলো
পেয়েছেন তারা হলেন মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার করটিয়া গ্রামের হাফেজ খায়রুল
আলম খোকন ও পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোডের এক মহিলা ।
Comments
Post a Comment